খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৪ শতাংশের কাছাকাছি

জাতীয় হারের তুলনায় শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি। নভেম্বরে শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে।

খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবার ১৪ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। টানা আট মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে আছে। বাজারে জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়েছেন। শীতের শুরুতে বাজারে শাকসবজির সরবরাহ বাড়লেও দাম তেমন কমছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপও কাজ করছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এটি গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল। নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার পাশাপাশি সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে উঠেছে। অর্থাৎ গত বছরের নভেম্বরে ১০০ টাকায় যে পণ্য ও সেবা কেনা গেছে, চলতি বছরের নভেম্বরে একই পরিমাণ পণ্য ও সেবা কিনতে ভোক্তাকে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার তদারকি—এই তিনের সমন্বয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও উন্নতি করতে হবে।
সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

এর আগে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল ২০১১ সালের মার্চ মাসে। তখন এই হার ছিল ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এরপর চলতি বছরের জুলাই মাসের খাদ্য মূল্যস্ফীতি সেই হার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে গত মার্চ মাসের পর থেকে টানা আট মাস খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে আর নামেনি।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিবিএসের প্রকাশ করা এই সর্বশেষ পরিসংখ্যান মূলত নভেম্বর মাসের চড়া বাজার পরিস্থিতিকেই প্রতিফলিত করেছে। আগের মাস অর্থাৎ অক্টোবর থেকেই প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দামই দৃশ্যত নিম্নবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়।

মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিলেও সেগুলো দৃশ্যত কাজ করছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিমধ্যে নীতি সুদহার ১০ শতাংশে বৃদ্ধি করেছে। পাশাপাশি পণ্যমূল্যের রাশ টেনে ধরতে সরকার খাদ্যপণ্যের আমদানিতে শুল্ক কমিয়েছে কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রত্যাহার করেছে। আমদানি সহজ করার জন্য ব্যাংকগুলোও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এর আগে বলেছেন, মূল্যস্ফীতি কমতে আরও খানিকটা সময় লাগবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, বিবিএস এখন যে পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি গণনা করে, তাতে গরিব মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপ কতটা অনুভব করেন, তা ঠিকমতো উঠে আসে না। সার্বিকভাবে জাতীয় গড় হিসাবে মূল্যস্ফীতির হিসাব আসে। বিবিএস যে পরিসংখ্যান দেয়, তার চেয়ে গরিব মানুষের ওপর খাদ্য মূল্যস্ফীতির চাপ অনেক বেশি। তাই গরিব মানুষ ভোগ করে এমন পণ্য ও সেবার ওপর ভিত্তি করে একটি আলাদা মূল্যস্ফীতির সূচক প্রকাশ করলে প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে।

সারা দেশের ৬৪টি জেলার ১৫৪টি হাটবাজার থেকে সাড়ে সাত শ পণ্য ও সেবার মূল্যের ওপরে নির্ধারিত সময়ে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে থাকে বিবিএস।

খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি শহরে

বিবিএসের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি গ্রামের চেয়ে বেশি। নভেম্বর মাসের হিসাবে, শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে। আর গ্রামে এই হার ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। এর মানে হলো গ্রামের মানুষের তুলনায় শহরের মানুষকে খাবার কিনতে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে।

বিবিএসের হিসাবে, একটি পরিবারকে গড়ে তাদের আয়ের ৪৮ শতাংশ অর্থই খাবার কেনার পেছনে খরচ করতে হয়। অন্যদিকে খাবার কিনতে গরিব পরিবারকে তাদের আয়ের দুই–তৃতীয়াংশের মতো অর্থ খরচ করতে হয়।

সার্বিক মূল্যস্ফীতি

খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশ অনেকটা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও। বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত নভেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে। গত অক্টোবরে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

গত নভেম্বর মাসে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি সামান্য বেড়েছে। গত মাসে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ; আগের অক্টোবর মাসে যা ছিল ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতি হলো একধরনের করের মতো, যা ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবার ওপর চাপ বাড়ায়। গত নভেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ হওয়ার মানে হলো, যে পরিবারের মাসিক খরচ ছিল ৫০ হাজার টাকা, সরকারি হিসাবে ওই পরিবারের খরচ এক বছরের ব্যবধানে গড়ে সাড়ে ৫ হাজার টাকার বেশি বেড়েছে।

সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশের বেশি হলেও জাতীয় মজুরি হার সে তুলনায় বাড়ছে না। গত নভেম্বর মাসে জাতীয় মজুরি হার হয়েছে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। এর মানে খরচের তুলনায় আয় বাড়েনি।

দেশে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে যে রাজনৈতিক সুবিধা পেতে আগে মূল্যস্ফীতি কম দেখানো হতো। অর্থনীতি নিয়ে চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে বিবিএস পরিসংখ্যানে কারসাজি করার অভিযোগ আনা হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রতিবেদন অনুসারে, গত এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১৫ থেকে ১৮ শতাংশের মধ্যে ছিল। কিন্তু বিবিএসের প্রকাশ করা পরিসংখ্যানে মূল্যস্ফীতি অনেক কম দেখানো হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা হবে।

এদিকে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য সেলিম রায়হান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, যা বেশ উদ্বেগের। বর্তমান সরকার মুদ্রানীতি দিয়ে, বিশেষ করে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তবে এতে বাজারে বড় কোনো প্রভাব পড়ছে না। মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার তদারকি—এই তিনের সমন্বয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও উন্নতি করতে হবে।