২০১৪ সালের ৪ জুলাই। ছুটির দিন শুক্রবার। সুনসান বিকেল। মন্ত্রিপাড়া হিসেবে পরিচিত ঢাকার হেয়ার রোডের সরকারি বাসা ‘তন্ময়’-এ ঢুকলেন বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতা শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু। একাই ঢুকলেন। সেটি ছিল তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসা। হঠাৎ আসেননি তিনি, সবুজ সংকেত পেয়েছিলেন। যোগাযোগ করে নিশ্চিত হয়েই আসেন যে অর্থমন্ত্রী বাসায় আছেন।
ওই দিনই বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই পদত্যাগপত্র জমা দেন আবদুল মুহিতের কাছে। পরদিন শনিবার সচিবালয়ে আবদুল মুহিতকে সাংবাদিকেরা জিজ্ঞাসা করেন, কী কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করলেন শেখ আবদুল হাই? অর্থমন্ত্রী মৃদু হেসে জবাব দিলেন, ‘এগুলো তো সাধারণত স্বাস্থ্যগত-ফত কারণ দেখিয়েই করা হয়।’
শুক্রবার কেন পদত্যাগ, তা–ও আবার একেবারে অর্থমন্ত্রীর সরকারি বাসায় গিয়ে? জানা গেল, দুই দিন পর রোববার ছিল চেয়ারম্যান হিসেবে আবদুল হাই বাচ্চুর স্বাভাবিক মেয়াদের শেষ দিন। তার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাঁর নেতৃত্বাধীন পুরো পর্ষদকে বরখাস্ত করার পরামর্শ ছিল। সরকার সে পথে না গিয়ে তাঁকে পদত্যাগ করার সুযোগ করে দেয়, যা প্রকারান্তরে তাঁর জন্য ‘সম্মানজনক’ হয়।
শেখ আবদুল হাইকে নিয়োগ দেওয়ার দায় মাথায় নিয়ে আবদুল মুহিত সেদিন মৃদুস্বরে এ-ও বলেছিলেন, ‘আমাদের অনেক সময় ভুল হয়। সে জন্য আমরা কাফফারা দিই। যখন নিয়োগ দিই, তখন তো জানি না। পরে টের পাই। ভালো লোক খুঁজে পাওয়াটা সত্যিই এ দেশে কঠিন।’ জালিয়াতি ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাইকে অপসারণ না করে তাঁকে পদত্যাগের সুযোগ করে দেওয়াকে ‘অনৈতিক কাজ হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর প্রয়াত খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।
সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বেসিক ব্যাংককে ধ্বংসের কিনারে নিয়ে যাওয়া শেখ আবদুল হাইকে আসামি করেই খালাস দুদক। তাকে গ্রেপ্তারে সংস্থাটির কোনো তৎপরতাও চোখে পড়ছে না। দুদকের করা এক মামলায় আসামি শেখ আবদুল হাই, তাঁর স্ত্রী, ভাই ও ছেলে-মেয়ে। একই মামলায় আসামি শেখ আবদুল হাইয়ের কাছে জমি বিক্রি করা আমিন আহমেদ। সম্প্রতি আমিন আহমেদকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
তাঁর নিয়োগ এখনো এক রহস্য
২০০৮ সালের ডিসেম্বরেরে শেষে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সেপ্টেম্বর থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন ও সাবেক নেতাদের সরকারি ব্যাংকের পর্ষদগুলোয় পরিচালক নিয়োগ দেওয়া শুরু করে সরকার।
ব্যতিক্রম হিসেবে জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে নিয়োগ দেওয়া হয় বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে। ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাট-১ আসন (চিতলমারী, মোল্লাহাট ও ফকিরহাট) থেকে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তিনি। কেন তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হলো, সে রহস্য এখনো অজানা। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে অবাধে তিনি লোক নিয়োগ দেন এবং প্রয়োজন ছাড়া খোলেন একের পর এক শাখা। ব্যাংকের বিপক্ষে যায়—একের পর এক এমন সিদ্ধান্তও নিতে থাকেন।
নিয়োগ পাওয়ার পর শেখ আবদুল হাইয়ের দুর্নীতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকলেও সরকার তা আমলে নেয়নি। তিন বছরের নিয়োগের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে আবার তাঁকে একই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তখন তাঁকে স্বাগত জানান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানকে ধন্যবাদ জানান।
সরকার মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে তখন লাভজনক ও সম্মানজনক মর্যাদায় ছিল বেসিক ব্যাংক। ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোর চেয়ে বেশি। খেলাপি ঋণ ছিল ৩ থেকে ৪ শতাংশ। শেখ আবদুল হাই চলে যাওয়ার পরপর ২০১৪ সাল শেষে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়ায় ৬৮ শতাংশে।
২০০৯ সালেও এ ব্যাংক ৬৪ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল। শেখ আবদুল হাইয়ের অপকীর্তির পর ব্যাংকটির লোকসান ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। কেলেঙ্কারির পর এখন পর্যন্ত বেসিক ব্যাংককে বাজেট থেকে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। কিন্তু ব্যাংকটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
তাঁর দৃশ্যমান ব্যক্তিগত লাভ
শেখ আবদুল হাই ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় ২০১২ সালে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ১৩৮ কাঠা জমির মালিক হয়েছেন। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই ব্লকে ৭১৯ ও ৭২০ নম্বরধারী প্লটের আয়তন ২২৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। ৩৩ শতাংশে ১ বিঘা হিসাবে প্লট দুটির আয়তন ৬ দশমিক ৯ বিঘা, অর্থাৎ প্রায় ৭ বিঘা। ২০ কাঠায় ১ বিঘা হিসাবে পুরো সম্পত্তির পরিমাণ ১৩৮ কাঠা।
২০১২ সালেই শেখ আবদুল হাই ও তাঁর ভাই শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্না ১১০ কোটি টাকা দিয়ে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট বাজার এলাকার শহীদ সরণিতে ৩০ দশমিক ২৫ কাঠা জমি ও একটি বাড়ি কিনেছিলেন। দুটি দলিলে এর দাম দেখানো হয় ১৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একক কর্তৃত্বে নামে-বেনামে ঋণ দিয়ে সেসব ঋণের একটি অংশ ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন তিনি ও তাঁর ভাই।
জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য শওকত চৌধুরী বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়েছিলেন। তিনি সরাসরিই বলেছিলেন, ঘুষ দিয়েই তিনি ঋণ পেয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকও তদন্ত করে দেখেছে কীভাবে শেখ আবদুল হাই ও তাঁর ভাইয়ের ব্যাংক হিসাবে ব্যাংকের গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা গেছে। ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি কেনার টাকাও দিয়েছেন গ্রাহকেরা।
২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার এক বছর দুই মাস পরই শেখ আবদুল হাইয়ের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ইডেন ফিশারিজের নামে ছয়টি এবং তাঁর ভাই শেখ শাহরিয়ারের প্রতিষ্ঠান ক্রাউন ফিশারিজের নামে কেনা হয় দুটি জাহাজ। এসব জাহাজের বাজারদর প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার আড়ুয়াঢিহি গ্রামে মা-বাবার নামে নতুন করে বাড়ি করেন শেখ আবদুল হাই। দোতলা এ বাড়ির নাম ‘শেখ হামিদ ও ছাবেদা ভিলা’। বসুন্ধরার জমি ও ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি বিক্রি করতে পারবেন না বলে আদালতের নির্দেশ রয়েছে। আর ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি কেনাকে কেন্দ্র করে গত বছরের অক্টোবরে ৯৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা করেছে দুদক।
শীর্ষ খেলাপি যারা
ব্যাংকটির দেওয়া ঋণের মধ্যে ৪ হাজার ৩৯০ কোটি টাকাই ২৫ গ্রাহকের কাছে। এর মধ্যে শুধু ম্যাক্স সোয়েটার, এবি গ্রুপ ও এসপিডিএসপির ঋণ নিয়মিত আছে। বাকি সবার ঋণই খেলাপি।
শীর্ষ খেলাপি গ্রাহকেরা হলো আমাদের বাড়ি, নিউ ঢাকা সিটি ডেভেলপমেন্ট, এমারেল্ড অটো ব্রিকস, আলী গ্রুপ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, নীলসাগর অ্যাগ্রো অ্যান্ড অ্যালাইড, ফিয়াজ গ্রুপ, অ্যারিস্ট্রোক্র্যাট গ্রুপ, মিমকো কার্বন লিমিটেড, ভাসাবী ফ্যাশন, ওয়েলটেক্স গ্রুপ, রাইজিং গ্রুপ, ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপিং, বাসার গ্রুপ, জেইল ওয়ারস, ম্যাপ অ্যান্ড মুলার গ্রুপ, ওয়েল ওয়েল, রিজেন্ট ওয়েভিং, আইজি নেভিগেশন, বে নেভিগেশন, এমারেল্ড অয়েল অ্যান্ড অ্যালাইড ও প্রফিউশন টেক্সটাইল লিমিটেড।
পুরস্কৃত আবদুল হাইয়ের সহযোগীরাও
আবদুল হাইকে চেয়ারম্যান করে ২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বেসিক ব্যাংকের যে নতুন পর্ষদ গঠন করে সরকার, সেই পর্ষদই ব্যাংকটির পতনের জন্য দায়ী বলে ধরা হয়। ওই দিন বেসিক ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুই মহাপরিচালক (ডিজি) শুভাশীষ বসু ও নীলুফার আহমেদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রাজিয়া বেগম, বিসিক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বিজয় ভট্টাচার্য।
এ ছাড়া বেসরকারি খাত থেকে পরিচালক হন চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, সাবেক শুল্ক কমিশনার শাখাওয়াত হোসেন, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী আখতার হোসেন এবং এ আর এস ল্যুভ বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের এমডি আনোয়ারুল ইসলাম।
শুভাশীষ বসু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) থেকে পদোন্নতি পেয়ে হন রপ্তানি উন্নয়ন বোর্ডের (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান। কেলেঙ্কারির পুরো সময় তিনি ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও বেসিক ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। পদোন্নতি পেয়ে তিনি বাণিজ্যসচিবও হয়েছিলেন।
ব্যাংকটির পরিচালক হওয়ার বছরেই বিজয় ভট্টাচার্যকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিস্টার পদে সরকার নিয়োগ দেয়। জেনেভা থেকে দেশে ফিরলে পদোন্নতি পেয়ে তিনি অতিরিক্ত সচিব হন এবং পরে হন ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান। বিজয় ভট্টাচার্য জেনেভা যাওয়ার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব কামরুন্নাহার আহমেদ পরিচালক হন। কেলেঙ্কারির পুরো সময়টাতেই তিনি এ ব্যাংকের পরিচালক থাকেন। পরে তিনি পদোন্নতি পেয়ে একই বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হন।
পর্ষদ সদস্য হওয়ার পর রাজিয়া বেগম পদোন্নতি পেয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব হন। ২০১০ সালের ৩১ জুলাই ব্যাংকের টুঙ্গিপাড়া শাখা উদ্বোধন করতে যাওয়ার সময় মানিকগঞ্জে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান সচিব রাজিয়া বেগম ও বিসিক চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান।
অতিরিক্ত সচিব ফখরুল ইসলাম নতুন বিসিক চেয়ারম্যান হলে তাঁকে বেসিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দেয় সরকার। এরপর তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে করা হয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) চেয়ারম্যান। তিনি ব্যাংকের পরিচালক পদেও থেকে যান। পরে বিসিক চেয়ারম্যান হন ব্যাংকটির পর্ষদ সদস্য শ্যামসুন্দর সিকদার। এরপর পদোন্নতি দিয়ে তাঁকে করা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব। তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিবের দায়িত্বও পালন করেন।
শেখ আবদুল হাইয়ের পাঁচ বছরের মেয়াদে এ ছাড়া পরিচালক ছিলেন আওয়ামী লীগের মুখপত্র মাসিক উত্তরণ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আনিস আহমেদ, সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ কামরুল ইসলাম এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব এ কে এম রেজাউর রহমান। আবদুল হাইয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে রেজাউর রহমান চিঠি পাঠালে তিনি এবং কামরুল ইসলাম বেসিক ব্যাংকে আর যেতেই পারেননি।
৭৬ কোটি দিয়ে দিলেন!
চেয়ারম্যান হওয়ার তিন মাস পরেই এক কেলেঙ্কারির সূত্রপাত করেন শেখ আবদুল হাই। বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের জন্য ভবন কেনা নিয়ে দুর্নীতি করেন তিনি। ২০০৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর আবদুল হাই বাচ্চু স্বাক্ষরিত ব্যাংকের ২৬১তম পর্ষদ সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ওই সভায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, ‘২০ বছর পার হলো, অথচ ব্যাংকের কোনো ভবন নেই! এটা হতে পারে না।’ ওই সভাতেই নিজস্ব ভবন করার সিদ্ধান্ত হয়। তাঁর একক কর্তৃত্বে বিরোধপূর্ণ সম্পত্তি কিনতে ব্যাংক থেকে দেওয়া হয় ৭৬ কোটি টাকা।
অথচ পরের ১৪ বছরেও ভবনের একটি তলাও (ফ্লোর) বুঝে পায়নি ব্যাংক। ভবনটির অবস্থান ঢাকার মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন ও সেনাকল্যাণ ভবনের বিপরীত দিকে। এ ভবন কিনতে সিঙ্কু আকরামুজ্জামান নামের একজনের সঙ্গে চুক্তি করেন, আনরেজিস্টার্ড বলে চুক্তিটির কোনো বৈধতা নেই। আবার যে জমির ওপর ভবন তৈরি হয়েছে, তা-ও তখন ছিল পরিত্যক্ত সম্পত্তি। ২০১০ সালের ১ এপ্রিল চুক্তি হয় সিঙ্কু আকরামুজ্জামানের সঙ্গে। চুক্তিতে বলা হয়, ভবনের নাম হবে ‘জামান বেসিক ব্যাংক টাওয়ার’। এখনো তা ব্যাংকের আয়ত্তে আসেনি।
অবশেষে মামলার আসামি
আত্মসাৎ করা অর্থে বাড়ি ও জাহাজ কিনে আরাম-আয়েশেই জীবন কাটাচ্ছিলেন আবদুল হাই বাচ্চু। এ নিয়ে বারবার আদালতের তিরস্কারের পাশাপাশি সংসদ সদস্য ও বিশেষজ্ঞদের বিরূপ সমালোচনার পর অবশেষে ২০২৩ সালের জুন মাসে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে আসামি হন তিনি।
আবদুল হাইসহ ১৪৫ জনের বিরুদ্ধে দুদক অভিযোগপত্র দিয়েছে ৫৯টি। এর মধ্যে ৫৮টিতেই শেখ আবদুল হাই আসামি। তবে তাঁর দুই মেয়াদের পর্ষদে যাঁরা পরিচালক ছিলেন, তাঁদের কাউকেই আসামি করেনি দুদক। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় যখন মামলা করা হয়, তখন দুদক চেয়ারম্যান ছিলেন মো. বদিউজ্জামান। তাঁর সময়ে মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। তারপর ২০১৬ সালে দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিয়ে ইকবাল মাহমুদ পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করলেও তদন্ত শেষ হয়নি তখনো। বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ ২০২১ সালে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর বেসিক ব্যাংকের মামলাগুলোর তদন্ত শেষ হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির জন্য শেখ আবদুল হাইকে সরাসরি দায়ী করলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে ও সংসদের বাইরে বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎকে ডাকাতির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারার জন্য তিনি হতাশাও প্রকাশ করতেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়ার আগে ফজলে নূর তাপস যখন সংসদ সদস্য ছিলেন, তখন ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর আদালতে তিনি বলেছিলেন, ‘শেখ আবদুল হাইয়ের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। এত বড় কেলেঙ্কারির পর তাঁকে গ্রেপ্তার না করা দুদকের ব্যর্থতা। এ ব্যাপারে দুদকের জবাবদিহি দরকার।’ এ ব্যর্থতার জন্য দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের পদত্যাগও চেয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু শেখ আবদুল হাই কোথায়? দুদক, পুলিশ, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, এমনকি আদালতও জানেন না। ধারণা করা হচ্ছে, পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, এনবিআরের সদস্য মতিউর রহমানদের মতো সপরিবারে তিনিও উন্নত কোনো দেশে নির্ভার ও আয়েশি জীবন যাপন করছেন।
আবার আবদুল হাই ভালো না-ও থাকতে পারেন। কারণ, এখন তিনি ভূসম্পত্তি বিক্রি করতে পারছেন না। তবু প্রশ্ন থেকে যায়, সরকারের একটি দপ্তরও কি নেই, যে দপ্তর তাঁকে ফিরিয়ে এনে অন্তত এটুকু জিজ্ঞাসা করবে যে কেন তিনি এগুলো করলেন এবং এ জন্য তিনি অনুতপ্ত কি না?