নির্মাণসামগ্রীর দাম ঊর্ধ্বমুখী
ফ্ল্যাটের দাম আরও নাগালের বাইরে
লালমাটিয়ায় প্রতি বর্গফুটের দাম ২–৩ হাজার টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা।
ধানমন্ডিতে গড় দাম প্রতি বর্গফুট ২ হাজার টাকা বেড়ে দঁড়িয়েছে ২০ হাজার টাকার বেশি।
মিরপুরেও প্রতি বর্গফুটে ১ হাজার টাকা বেড়ে ৬ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
ঢাকায় ফ্ল্যাটের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরেই ছিল। গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়তি। তাতে ফ্ল্যাটের দাম এক দফা বেড়েছে। ডলার–সংকট ও চলতি মাসের শুরুতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে নতুন করে আবার রড, সিমেন্টসহ প্রায় সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে। তাতে আরেক দফা বাড়তে চলেছে ফ্ল্যাটের দাম। সব মিলিয়ে ফ্ল্যাট কেনা আরও দুঃস্বপ্নের হতে যাচ্ছে মধ্যবিত্তের জন্য।
আবাসন ব্যবসায়ীরা জানালেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছর কোম্পানি ও এলাকাভেদে নতুন প্রকল্পে ফ্ল্যাটের দাম প্রতি বর্গফুটে ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা বেড়েছে। নতুন করে আবার নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ছে। ফলে ফ্ল্যাটের দাম আবারও বাড়াতে হবে।
নির্মাণসামগ্রীর দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। দুই মাস আগে আমরা হিসাব করে দেখেছিলাম, প্রতি বর্গফুটে কমপক্ষে ৫০০ টাকা নির্মাণ খরচ বেড়েছে। নির্মাণসামগ্রীর বর্তমান বাজারদর হিসাব করলে সেই খরচ আরও বাড়বে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লালমাটিয়ায় গত বছর যে ফ্ল্যাটের দাম প্রতি বর্গফুটে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার ছিল, চলতি বছর তা বেড়ে হয়েছে ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা। গত বছর ধানমন্ডিতে গড় দাম ছিল ১৮ হাজার টাকা বর্গফুট। বর্তমানে প্রতি বর্গফুট ২০ হাজার টাকার বেশি। মিরপুরেও যে ফ্ল্যাট প্রতি বর্গফুট ৫ হাজার টাকার কিছুটা নিচে ছিল, সেগুলো এখন ৬ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবাসন খাত এখন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। নির্মাণসামগ্রীর দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। দুই মাস আগে আমরা হিসাব করে দেখেছিলাম, প্রতি বর্গফুটে কমপক্ষে ৫০০ টাকা নির্মাণ খরচ বেড়েছে। এখন নির্মাণসামগ্রীর বর্তমান বাজারদর হিসাব করলে সেই খরচ আরও বাড়বে।’ তিনি বলেন, করোনাকালে কোম্পানিগুলো নতুন প্রকল্প নেওয়া কমিয়ে দেয়। সে কারণে বর্তমানে চাহিদার তুলনায় ফ্ল্যাটের জোগান কিছুটা কম। তাই অবিক্রীত ফ্ল্যাট কম। তবে জোগান বেশি থাকলে বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসার মন্দাভাব সব কোম্পানির ক্ষেত্রেই প্রকট হতো।
ডলার ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নতুন করে রড, সিমেন্টসহ প্রায় সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে।
২০১১ সালে আবাসন ব্যবসায় নামে ইনটেক প্রোপার্টিজ। ইতিমধ্যে কোম্পানিটি ১০০ ফ্ল্যাট হস্তান্তর করেছে। বর্তমানে তাদের ১৮ প্রকল্প নির্মাণাধীন রয়েছে। এসব প্রকল্পে ফ্ল্যাট সংখ্যা প্রায় ৩০০। প্রতিষ্ঠানটির সব প্রকল্পই মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায়।
ইনটেক প্রোপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রড, সিমেন্ট, ইট, বালু থেকে শুরু করে সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে। শ্রমিকের মজুরি বেড়ে গেছে। তাতে গত বছর মিরপুরে যে ফ্ল্যাট প্রতি বর্গফুটে ৫ হাজার টাকার আশপাশে বিক্রি করেছি, বর্তমানে তা ৬ হাজার টাকার বেশি দামে বিক্রি করলেও লোকসান হবে।’
গত বছর ডিসেম্বরে প্রতি টন রড ৭৫ হাজার থেকে ৭৮ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত সপ্তাহে প্রতি টন রডের দাম বেড়ে হয়েছে ৮৭ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ৯১ হাজার ৮০০ টাকা। দাম আরও বাড়বে বলছেন ইস্পাত খাতের ব্যবসায়ীরা। তাঁদের বক্তব্য, তিন কারণে রডের দাম বাড়ছে। প্রথম কারণ, ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। এ জন্য কাঁচামাল আমদানি খরচ বেড়েছে ২০ শতাংশ। দ্বিতীয় কারণ, ৬ আগস্ট থেকে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। তাতে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। আর তৃতীয় কারণ, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে কারখানাগুলোর উৎপাদন কমেছে। তাতে রডের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। রডের মতো সিমেন্টের বাজারও উত্তপ্ত। গত ডিসেম্বরে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ছিল ৪০০-৪৫০ টাকা। গত সপ্তাহে প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে কোম্পানিভেদে ৫৪০ থেকে ৫৫০ টাকা।
২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে আবাসন খাতের শক্ত অবস্থান গড়ে নিয়েছে ক্রিডেন্স হাউজিং। বর্তমানে ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় তাদের বেশ কিছু ফ্ল্যাট প্রকল্প চলমান রয়েছে।
ক্রিডেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জিল্লুল করিম বলেন, ‘চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত নির্মাণসামগ্রীর দাম প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। সে কারণে আমাদের প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা বৃদ্ধি করতে হয়েছে। হঠাৎ করে ফ্ল্যাটের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেতারা একটু ধীরে চলা নীতি নিয়েছেন। তাতে ব্যবসায় কিছুটা ধাক্কা লেগেছে।’
জানা যায়, আবাসন ব্যবসায়ীরা গত বছরের আগে নেওয়া প্রকল্প নিয়ে বিপদে আছেন। কারণ, চুক্তির বাধ্যবাধকতার কারণে বর্তমানে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়লেও ক্রেতার কাছ থেকে বেশি অর্থ আদায় করা সহজ হচ্ছে না। সে জন্য রিহ্যাব আগে বুকিং দেওয়া ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুটের দাম ৫০০ টাকা বাড়ানোর একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তবে তা বাস্তবায়নের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়নি।
রিহ্যাবের সহসভাপতি মোহাম্মদ সোহেল রানা বলেন, ‘দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিলে বাজারে কী ধরনের প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে আমরা এখনো ভাবছি। তা ছাড়া নির্মাণসামগ্রীর দাম এখনো বাড়তির দিকেই আছে। সে কারণে আমরা আরেকটু হিসাব–নিকাশ করে সিদ্ধান্ত নেব।’ নির্মাণসামগ্রীর দাম যতটুকু বেড়েছে, তার চেয়ে ফ্ল্যাটে দাম বেশি বাড়ছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অতিরিক্ত বাড়লে একটা সময় পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাজার সংশোধন হবে।