সম্পত্তি ক্রয় ও ব্যবসায় অনুমতি নেননি মতিউর
ছাগল-কাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমান সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার গুরুতর লঙ্ঘন করেছেন। তিনি তিন ধরনের আচরণবিধি মানেননি।
প্রথমত, বাড়ি, গাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাবর সম্পদ কেনার আগে মতিউর রহমান কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেননি। দ্বিতীয়ত, ‘ফাটকা ব্যবসায় বিনিয়োগে নিষেধাজ্ঞা’ সত্ত্বেও শেয়ারবাজারে তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের বিনিয়োগ আছে। তৃতীয়ত, মতিউর রহমান ও তাঁর ছেলে-মেয়েদের নামে একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মালিকানা আছে, যা সুস্পষ্টভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘনের শামিল।
সম্পদ কেনা এবং বিনিয়োগ ও ব্যবসা করার ক্ষেত্রে মতিউর রহমান এনবিআর কিংবা অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের কোনো অনুমতি নেননি। এনবিআরের প্রশাসন শাখায় খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। এই শাখার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মতিউর রহমান জমি, বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ— কোনো ক্ষেত্রেই এনবিআরের অনুমতি নেননি।
ওই শাখার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, শুধু মতিউর রহমান নন, সরকারি অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীই জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ সম্পদ কেনার আগে অনুমতি নেন না। আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে তাঁরা সম্পদ লুকিয়ে রাখেন। সাধারণত কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার সময় এনবিআর থেকে অনুমতি নেওয়ার জন্য প্রশাসন বিভাগে আবেদন করেন।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে এনবিআরের শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসন-সংক্রান্ত সদস্য ফারজানা আফরোজের মুঠোফোনে কল করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মতিউর রহমান সরকারি বিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন করেছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও সরকারি চাকরির বিধান বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, স্থাবর সম্পদ কেনা ও ব্যবসা করার আগে অনুমতি না নেওয়ার মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে সরকারি চাকরি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন এনবিআরের মতিউর রহমান। সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুসারে, সম্পদ অর্জনের আগে অনুমতি নিতে হবে। আর ব্যবসা ও শেয়ারবাজারে তো বিনিয়োগই করতে পারবেন না। এটি গুরুতর অপরাধ। দুদকের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগও এখন বিভাগীয় তদন্ত করতে পারে।
বিধিমালায় যা আছে, মতিউর যা করেছেন
১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা অনুসারে, কোনো সরকারি কর্মচারী তাঁর কর্মস্থল, জেলা ও স্থানীয় অধিক্ষেত্রে ১৫ হাজার টাকার বেশি মূল্যমানের স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়, বিক্রয় বা হস্তান্তরের আগে বিভাগীয় অনুমোদন নিতে হবে। এমনকি অনুমতি ছাড়া আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনও নির্মাণ করতে পারবেন না। ভবন নির্মাণের অনুমতি নেওয়ার সময় অর্থের উৎস সম্পর্কে জানাতে হবে। এ ছাড়া নিজের ও পরিবারের সদস্যদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব পাঁচ বছর পরপর জানানোর বিধান আছে।
এনবিআরের আলোচিত কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও তাঁর স্বজনদের নামে এখন পর্যন্ত ৬৫ বিঘা (২ হাজার ১৪৫ শতাংশ) জমি, আটটি ফ্ল্যাট, দুটি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট এবং তিনটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, যশোর ও নাটোরে মোট ৮৪৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ (২৫ দশমিক ৭০ বিঘা) জমি রয়েছে। আর ঢাকাতেই তাঁর নামে ফ্ল্যাট রয়েছে অন্তত চারটি। ২০২৩-২৪ করবর্ষের আয়কর বিবরণীতে লায়লা কানিজ তাঁর মোট সম্পদ দেখিয়েছেন ১০ কোটি ৩০ লাখ ৫১ হাজার টাকা।
সরকারি চাকরি বিধিমালায় বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বিনিয়োগের ফাটকা ব্যবসা করবেন না, যা অফিসের দায়িত্ব পালনে তাঁকে বিব্রত বা প্রভাবিত করতে পারে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকেই এখানে ফাটকা ব্যবসা বোঝানো হয়েছে।
শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম ও ঢাকাভিত্তিক দুটি ব্রোকারেজ হাউসে নিজের, ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীর নামে খোলা পাঁচটি বিও হিসাব থেকে মতিউর রহমান মুনাফা তুলেছেন প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে তাঁর নিজের প্রায় চার কোটি টাকা, মেয়ে ফারজানা রহমান ঈপ্সিতা ২৩ কোটি টাকা, ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব ৮ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলীর ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা আছে।
সরকারি আচরণবিধিতে আরও বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ব্যবসা করতে পারবেন না। এখন পর্যন্ত মতিউর রহমানের নামে-বেনামে এবং ছেলে–মেয়েদের নামে একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকানার খোঁজ পাওয়া গেছে। যেমন প্রথম পক্ষের মেয়ে কানাডাপ্রবাসী ফারজানা রহমানের নামে গ্লোবাল শুজ অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেডের ৪৯ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০টি শেয়ার এবং ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমানের নামে ১ লাখ ৬২ হাজার ৫০০টি শেয়ার আছে। এ ছাড়া একাধিক প্রতিষ্ঠানে তাঁর সন্তানদের মালিকানা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। নিজের দুই ভাই কাইয়ুম হাওলাদার ও নুরুল হুদা, বোন হাওয়া নূর বেগমের এসকে ট্রিমস ও গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিতে মালিকানা আছে।