দুর্নীতির চক্র ভাঙতে আইন যথেষ্ট নয়, দরকার নতুন বন্দোবস্ত: মুশতাক খান
দুর্নীতির চক্র ভাঙতে হলে কেবল আইনই যথেষ্ট নয়, বরং দরকার ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও নতুন বন্দোবস্ত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিসরে আরও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। সেটা হলে ভারসাম্য থাকবে এবং দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা সম্ভব হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ মুশতাক খান।
মুশতাক খান আরও বলেন, দুর্নীতি রোধে দেশে অনেক আইন বিদ্যমান, কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন নেই। দুর্নীতির চক্র জিইয়ে রাখা এবং নিজেদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখতে হাজার হাজার মানুষ মেরে ফেলা বা গুম করে ফেলার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব নেই। কিন্তু দুর্নীতি রোধ করার ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থ নেই, কারণ, তারা নিজেরাই দুর্নীতিতে জড়িত।
আজ রোববার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন বা বঙ্গোপসাগর সংলাপ’ শীর্ষক তিন দিনের অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনের প্রথম অধিবেশনে এ কথা বলেন ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (সোয়াস) অর্থনীতির অধ্যাপক মুশতাক খান। সোয়াস অ্যান্টিকরাপশন এভিডেন্স (এসিই) রিসার্চ কনসোর্টিয়ামের নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও কাজ করছেন তিনি।
দুর্নীতি ও আইনের সম্পর্ক প্রসঙ্গে মুশতাক খান বলেন, কিছু কিছু বিষয় সহজে সমাধান করা যায়, আবার কিছু কিছু বিষয় অনেক জটিল। সেগুলো ভাঙা কঠিন। বাংলাদেশের কনিষ্ঠ চিকিৎসকদের জন্য একটি নিয়ম আছে। সেটা হলো, কিছুদিন গ্রামাঞ্চলে থেকে চিকিৎসা দিতে হবে। কিন্তু সেখানকার পরিস্থিতি এ রকম যে নারী চিকিৎসকেরা নিরাপদ বোধ করেন না। সেই সঙ্গে স্কুলসহ বিভিন্ন নাগরিক সেবার অনেক ঘাটতি আছে। ফলে এই বিধান অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকর।
আরেকটি বিষয় হলো, মানুষ আইন ভঙ্গ করে সুবিধা পায়। সে জন্য একধরনের যোগসাজশ গড়ে ওঠে; এককভাবে তা হয় না। রাজনৈতিক দলও সেখান থেকে ভাগ পায়। ফলে শুধু আইন করে এ ধরনের যোগসাজশ ভাঙা যায় না বলে মনে করেন মুশতাক খান।
এই পরিস্থিতি ভাঙতে হলে ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে বলে মত দেন মুশতাক খান। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে ঠিক সেটাই হয়েছে। এত দিন মানুষ ভয়ে অনেক কথা বলতে পারেনি বা অনেক কিছু করতে পারেনি। কিন্তু জুলাইয়ে সব ভয় ভেঙে গেছে। দুর্নীতির চক্র ভাঙতে গেলেও একই রকম সাহস দেখাতে হবে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের শাসনবিষয়ক জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ তানভীর মাহমুদ। আরও আলোচনা করেন নেপালের পলিসি এন্ট্রাপ্রেনিউয়ার্স ইনকরপোরেটেডের পরিচালক অনুরাগ আচারিয়া ও পাকিস্তানের অ্যাকাউন্টিবিলিটি ল্যাবের নির্বাহী পরিচালক ফায়াজ ইয়াসিন ভিদাল।
অনুরাগ আচারিয়া বলেন, দুর্নীতি দক্ষিণ এশিয়ার সমাজের অন্তর্নিহিত বিষয়। নেপালে গত কয়েক বছরে বড় ধরনের রাজনৈতিক ভাঙাগড়া হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতি আছেই; সেই দুর্নীতির ফসল রাজনীতিকদের ঘরেও যাচ্ছে। রাজনৈতিক নতুন বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে যেটা হয়েছে সেটা হলো, দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণ। এই বাস্তবতা দেশটির তরুণদের জন্য আশাব্যঞ্জক নয়। তারা মনে করছে, নেপালের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এই বাস্তবতা দুঃখজনক।
ফায়াজ ইয়াসিন দুর্নীতির বিভিন্ন ধরনের ওপর আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, একধরনের মানুষ আছেন, যাঁরা সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়াতে বা পরিবারের সদস্যদের ভালো চিকিৎসা করাতে দুর্নীতি করেন। আরেক দল আছেন, যাঁরা সম্পদ গড়তে দুর্নীতি করেন; তিনি এর নামকরণ করেন লোভভিত্তিক দুর্নীতি। এই শ্রেণির মানুষেরা বিদেশে অর্থ পাচার করেন।
অর্থ পাচারের প্রসঙ্গে ফায়াজ ইয়াসিন ভিদাল আরও বলেন, দুবাইয়ে বিদেশিরা যত সম্পদ কেনেন, তার এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তানি; তাঁরা আবার বড় ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি নন, সরকারি কর্মকর্তা। দুর্নীতি আটকাতে আইন যথেষ্ট নয় মন্তব্য করে তাঁর পরামর্শ, মানুষ সৎ থাকলে যেন পুরস্কৃত করা হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
এ বিষয়ে মুশতাক খানও একই সুরে বলেন, দুর্নীতি আটকাতে কেবল ব্যক্তি মানুষের নীতিনৈতিকতার ওপর ভর করলে চলবে না, সেই মানুষদের বাহবা দিতে হবে। দুর্নীতি এককভাবে হয় না, হয় দলগতভাবে। সে জন্য ক্ষমতার ভারসাম্য থাকতে হবে। মানুষ যেন দুর্নীতি করতে উৎসাহিত না হন, তা নিশ্চিত করতে হবে।
ক্ষমতায়ন ও সংস্কার
অনুষ্ঠানে সংস্কার নিয়ে আলোচনা করেন মুশতাক খান। বলেন, অতীতেও সংস্কার হয়েছে, আইন হয়েছে; কিন্তু রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর তা ফেলে দিয়েছে। সে জন্য তাঁর মত, সংস্কার করতে হলে সমাজের ক্ষমতায়ন দরকার। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণও করতে হবে।
বাস্তব উদাহরণ দিয়ে মুশতাক খান বলেন, রাজধানীর গুলশান এলাকায় গুলশান ও ঢাকা চাকা নামে দুটি চক্রাকার বাসসেবা আছে। মানুষ সেখানে নিয়ম মেনে ও লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে ওঠেন, কিন্তু রাজধানীর অন্যত্র, বিশেষ করে উপকণ্ঠে এই চিত্র দেখা যায় না। সেখানে হুড়াহুড়ি বা গুঁতোগুঁতি করে বাসে উঠতে হয়, তা না হলে ওঠা যায় না। গুলশানে কেউ এটা করতে গেলে অন্য যাত্রীরা তাঁকে আটকে দেবেন, কারণ, সেখানে যাঁরা থাকেন বা যাতায়াত করেন, তাঁদের সেই সচেতনতা বা সামর্থ্য আছে। ফলে সেখানে এ নিয়ে হট্টগোল হলে পুলিশ আইন ভঙ্গকারী ব্যক্তিকে ধরতে বাধ্য হবে, তিনি যতই ক্ষমতাবান হোন না কেন। সেখানে একধরনের ভারসাম্য আছে বলে এটা সম্ভব, যেটা আবার অন্য জায়গায় সম্ভব নয়। সে জন্য তিনি মানুষের ক্ষমতায়নে জোর দেন।
একইভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা দাবিদাওয়া নিয়ে অগ্রসর হলে বা শক্তিশালী অবস্থান নিলে বড় ব্যবসায়ীরা সব সুবিধা কুক্ষিগত করতে পারবে না বলে মনে করেন মুশতাক খান। এত দিন কয়েকজন মিলে ব্যাংক লুট করেছে, কিন্তু অন্যরা কেই কিছু বলেনি। কারণ, মুখ খুললে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সে জন্য সাহস দরকার বলে মনে করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীরা অংশ নেন। তিন দিনব্যাপী এই সংলাপে বিশ্বের ৮০টি দেশের লেখক, গবেষক, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, আমলা, শিক্ষাবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন। ভূরাজনীতি, অপতথ্য, মানবাধিকারসহ পাঁচটি বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।