বিবিএসের জরিপের তথ্য
শহর ছেড়ে গ্রামে ফেরা মানুষের সংখ্যা এক বছরে দ্বিগুণ
সর্বশেষ ২০২২ সালে শহরে বসবাসকারী প্রতি হাজার মানুষের মধ্যে ১১ জন গ্রামে ফিরে গেছেন। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল হাজারে ৬ জন।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকায় একটি বেকারি কারখানায় ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করতেন মো. মাহমুদুল হাসান। সস্ত্রীক ২০২১ সালে ঢাকায় এসে যোগ দেন এ কাজে। গত এপ্রিলে কারখানাটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর নানা জায়গায় চেষ্টা-তদবির করেও নতুন কোনো কাজ পেলেন না মাহমুদুল হাসান।
শেষ পর্যন্ত তাই পরিবার নিয়ে ফিরে গেছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গ্রামের বাড়িতে।
জানতে চাইলে গতকাল বুধবার মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিচালনা খরচ বেড়ে যাওয়ায় বেকারির মালিক কারখানাটি আর চালাতে পারেননি। এ কারণে সেখানে কাজ করা ১৫ জন কর্মীর অধিকাংশই রাজধানী ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। আমিও ঢাকায় কোনো কাজ খুঁজে না পেয়ে বাধ্য হয়ে গ্রামে ফিরে এসেছি। চেষ্টা করছি গ্রামে নিজে কিছু করার।’
মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে গেলে কিংবা গ্রাম ছেড়ে শহরে এলেই পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে না। সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানো না গেলে তাঁদের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা আরও বাড়বে।
মাহমুদুল হাসানের মতো নানা পেশা ও আয়ের মানুষের মধ্যে শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপেও এ প্রবণতার চিত্র উঠে এসেছে। স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস নামে এ জরিপ করেছে বিবিএস।
বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, শহর থেকে গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা এক বছরের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সর্বশেষ ২০২২ সালে শহরে বসবাসকারী প্রতি হাজার মানুষের মধ্যে ১১ জন গ্রামে ফিরে গেছেন। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল হাজারে ৬ জন।
গত মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা জরিপের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মানুষের মধ্যে শহর থেকে গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল ২০২০ সালে। এর আগে এ সংখ্যা ছিল খুবই কম। অন্যদিকে গত বছর গ্রাম ছেড়ে শহরে কিংবা এক শহর ছেড়ে অন্য শহরে স্থানান্তরের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জরিপে দেখা গেছে।
পরিচালনা খরচ বেড়ে যাওয়ায় বেকারির মালিক কারখানাটি আর চালাতে পারেননি। এ কারণে সেখানে কাজ করা ১৫ জন কর্মীর অধিকাংশই রাজধানী ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। আমিও ঢাকায় কোনো কাজ খুঁজে না পেয়ে বাধ্য হয়ে গ্রামে ফিরে এসেছি। চেষ্টা করছি গ্রামে নিজে কিছু করার।
গবেষক ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সামগ্রিকভাবে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ যে কষ্টে রয়েছেন, সেটির বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় গ্রাম ও শহর উভয় স্থানে মানুষের স্থানান্তর বেড়ে যাওয়ার মাধ্যমে। তাঁরা বলছেন, করোনার সময় নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো কমেনি; বরং দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে এ সংকট আরও প্রকট হয়েছে। তাই বেঁচে থাকার চেষ্টায় মানুষের শহর থেকে গ্রামে ও এক শহর থেকে অন্য শহরে স্থানান্তরও বেড়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমেছে। এর সঙ্গে বাড়তি চাপ হিসেবে রয়েছে মূল্যস্ফীতি। এসব কারণে দরিদ্র মানুষ যে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন, সেটিই বিবিএসের জরিপের তথ্য আমাদের দেখাচ্ছে। মানুষ এখন টিকে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। গ্রাম কিংবা শহর যে যেখানেই আছেন, তারা বেঁচে থাকার চেষ্টার অংশ হিসেবে অন্যত্র স্থানান্তর হতে চাচ্ছেন।’
বিবিএসের জরিপের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে প্রতি হাজারে ৪৮ জন গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। ২০২২ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৫।
বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক—উভয় ধরনের অভিবাসন বেড়েছে। গত বছর দেশের অভ্যন্তরে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় আগের বছরের তুলনায় হাজারে ছয়জনের বেশি অভিবাসী হয়েছেন। আর আগের বছরের তুলনায় প্রতি হাজারের বিপরীতে দ্বিগুণের বেশি মানুষ দেশের বাইরে অভিবাসী হয়েছেন গত বছর। ২০২১ সালে প্রতি হাজারে ৩ জন দেশ ছেড়ে বিদেশে অভিবাসী হয়েছিলেন। গত বছর এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে হাজারে ৬ দশমিক ৬।
এদিকে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের ক্ষেত্রে শহর থেকে গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের সংখ্যাও। তবে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়া মানুষের অভিবাসন কমেছে। বিবিএসের জরিপের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে প্রতি হাজারে ৪৮ জন গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। ২০২২ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৫।
করোনাকালে শহর ছেড়ে কী পরিমাণ মানুষ গ্রামে গেছেন, তা নিয়ে গবেষণা করেছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে করা ওই গবেষণার তথ্যে দেখা যায়, করোনাকালে রাজধানী ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে অন্তত ১৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা খরচ, যোগাযোগের খরচ বেড়ে যাওয়া ও নানামুখী ব্যয় মেটাতে না পেরেই এসব মানুষ ঢাকা ছেড়েছে।
পিপিআরসি ও বিআইজিডি জানিয়েছিল, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মধ্যে বাসাবাড়িতে কাজ করা মানুষ, যাঁদের বেশির ভাগই নারী, তাঁদের মধ্যে কাজ হারানোর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। এরপর আছে বিভিন্ন খাতের অদক্ষ শ্রমিক।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ খাদ্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। যার ধাক্কা এসে লাগে বাংলাদেশেও। সব ধরনের নিত্যপণ্যসহ জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। চাপে পড়ে সাধারণ মানুষ। চলতি বছরও মানুষের ওপর এ চাপ অব্যাহত রয়েছে। এ জন্য কর্ম হারানো এবং শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার প্রবণতা কমেনি বলে ধারণা অর্থনীতিবিদদের।
অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে গেলে কিংবা গ্রাম ছেড়ে শহরে এলেই পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে না। সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানো না গেলে তাঁদের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা আরও বাড়বে।