সেরা করদাতার তালিকায় বড় শিল্পপতিদের নাম কোথায়?
# সেরা করদাতার প্রথম তালিকা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে।
# প্রথম সেরা করদাতা ছিলেন রংপুরের এক বিড়ি ব্যবসায়ী।
# ২০০৮ থেকে সেরা করদাতা জর্দা ব্যবসায়ী কাউছ মিয়া।
দেশে প্রথমবারের সেরা করদাতার পুরস্কার বা সম্মাননা দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। ২০ জনের তালিকা করা হয়েছিল। রংপুরের একজন বিড়ি ব্যবসায়ী সেবার দেশের সর্বোচ্চ করদাতা হয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন।
অনুষ্ঠানটি হয়েছিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সম্মেলনকক্ষে। এম সাইফুর রহমান তখন অর্থমন্ত্রী। ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ী কেউ নন, রংপুরের একজন বিড়ি ব্যবসায়ীর সেরা করদাতা হওয়ার তথ্য অনেকেরই ভালো লাগেনি। তালিকায় দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের নামই ছিল না। সেসব বড় ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর চাপে দীর্ঘদিন সর্বোচ্চ করদাতার তালিকা প্রকাশ করা বন্ধ ছিল।
২০০৬ সালে এসে আবার একটি তালিকা করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সে সময়ে এনবিআর চেয়ারম্যান ছিলেন খায়রুজ্জামান চৌধুরী। তালিকা করেও নানা চাপে তা–ও শেষ পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। ২৫ জনের সেই তালিকাটিও ছিল চমকে ভরা। তালিকার শীর্ষে ছিলেন চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জের এনজিএস গ্রুপের অসিত কুমার সাহা। এর প্রতিষ্ঠাতা ননী গোপাল সাহা, অসিত কুমার সাহা তাঁরই বড় ছেলে। তিনি ২০০৪-০৫ সময়ে আয়কর দিয়েছিলেন প্রায় ৮৪ লাখ টাকা। তাঁরই ভাই অশোক কুমার সাহা ছিলেন তৃতীয় শীর্ষ আয়করদাতা।
সেই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটার মজুমদার ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আদিত্য মজুমদার ভাই। চতুর্থ স্থানে ছিলেন স্কয়ার গ্রুপের স্যামসন এইচ চৌধুরী। এরপরের নামটিই ছিল ঢাকার আগা নওয়াব দেউরীর জর্দা ব্যবসায়ী হাজি মো. কাউছ মিয়া। ষষ্ঠ স্থানে ছিলেন রংপুরের বিড়ি ব্যবসায়ী আলহাজ রহিম উদ্দিন মিয়া ভরসা, সপ্তম স্থানে ঢাকার মিতালি মিউনিসিপ্যাল মার্কেটের মেসার্স মদিনা পোলট্রি ফিডের মো. ফজলুল সালাম। তালিকায় একমাত্র চাকরিজীবী ছিলেন ইউনিলিভারের সে সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সঞ্জীব মেহতা।
নবম থেকে ১৩তম স্থান পর্যন্ত নামগুলো ছিল একই কোম্পানির পরিচালকদের। যেমন ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ডা. এম এম আমজাদ হোসেন, মো. ইউসুফ, রুবাইয়াত ফারজানা হোসেন, খাজা আজমল এবং এম এ হায়দার হোসেন। তালিকায় ১৪তম নামটি ছিল যশোরের নাজির শংকরপুরের খন্দকার ওহিদুজ্জামান ও ১৫তম স্থানে ঢাকার পুরানা পল্টনের ইকবাল হায়দার চৌধুরী। ১৬ ও ১৭তম স্থানে আবার ড্রাগ ইন্টারন্যাশনালের আরও দুই পরিচালক হোসনে আরা হোসেন ও লায়লা হোসেন। ১৮তম থেকে ২১তম স্থানে যথাক্রমে চট্টগ্রামের শেখ মুজিব রোডের এম ইকরামুল করিম, রাজশাহীর সাহেব বাজারের ফুল মোহাম্মদ, সৈয়দপুরের জিকরুল হক রোডের মো. একরাম এবং চট্টগ্রামের ইমন মার্কেটের আসাদুজ্জামান। তালিকায় ২২, ২৩ ও ২৪তম শীর্ষ আয়করদাতা স্কয়ার গ্রুপের তিন ভাই—যথাক্রমে অঞ্জন চৌধুরী, তপন চৌধুরী ও স্যামুয়েল এস চৌধুরী। আর তালিকার সর্বশেষ নামটি ছিল ঢাকার কে বি রোডের এস কে ট্রেডার্সের সঞ্জিত কুমার সাহার।
এর দুই বছর পরে ২০০৮ সাল থেকেই মূলত শীর্ষ আয়করদাতাদের তালিকা প্রকাশ করে পুরস্কার দেওয়ার প্রথা চালু আছে। সেই থেকেই দেশের শীর্ষ আয়করদাতা জর্দা ব্যবসায়ী কাউছ মিয়া। অথচ বড় শিল্পপতি পরিচয়ে যাঁরা দাপিয়ে বেড়ান, সরকারি নানা আনুকূল্য নেন, নানা ধরনের পদ নিয়ে বসে থাকেন, সভা-সমিতি ও সেমিনারে বড় বড় বক্তৃতা দেন, ব্যবসায়ীদের নেতৃত্ব দেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই নাম থাকে না শীর্ষ আয়করদাতার তালিকায়। সেরা করদাতার গত ছয় বছরের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, শুধু কাউছ মিয়াই নন, তালিকায় এমন ১৫ জন করদাতা আছেন, যাঁরা নিজ নিজ শ্রেণিতে প্রতিবারই সেরা করদাতা হন।
ধন জিনিসটাকে আমাদের দেশ সচেতনভাবে অনুভব করিতেই পারিল না, এই জন্য আমাদের দেশের কৃপণতাও কুশ্রী, বিলাসও বীভৎস
প্রশ্ন হচ্ছে, সেরা করদাতাদের তালিকায় বড় ব্যবসায়ীরা কেন থাকেন না? উত্তর একটাই, আয় গোপন করে কর ফাঁকি দেন তাঁরা। আয়ের তথ্য তাঁরা যেমন গোপন করেন, অনেকে আবার আইনের ফাঁকফোকর গলে কর দেওয়া এড়িয়ে যান। মাছ চাষে আয়কর রেয়াত ছিল বলে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদের রাতারাতি মৎস্য ব্যবসায়ী বনে যাওয়ার তথ্য অনেকেরই জানা আছে। আবার দেশে এমন অনেক ধনী আছেন, যাঁরা বিলাসবহুল গাড়িতে চড়েন, ততোধিক বিলাসবহুল বাড়িতেও থাকেন। তবে ওই বাড়ি-গাড়ি কোম্পানির নামে। অর্থাৎ চেয়ারম্যান বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়ার কারণে কোম্পানি বিলাসবহুল বাড়িতে থাকতে দেয়, গাড়িতে চড়তে দেয়। বাংলাদেশে এ রকম কৌশলী ধনীর সংখ্যাই হয়তো বেশি। আবার কর–বিরোধ নিয়ে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা থাকে। নিয়ম অনুযায়ী, মামলা নিষ্পত্তি না হলে তালিকায় নাম ওঠানো হয় না।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান খায়রুজ্জামান চৌধুরী একবার একটা গল্প বলেছিলেন। তিনি একবার বিদেশি এক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বাসায় গিয়েছিলেন। সেই ব্যাংকারের থাকার জন্য ব্যাংক থেকেই গুলশানের একটি বিলাসবহুল বাড়ি ভাড়া করা হয়েছিল। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বাড়ির মালিকের নামটি জেনে নেন। এনবিআর চেয়ারম্যান পরের দিনই অফিসে এসে প্রতিষ্ঠিত ওই ব্যবসায়ীর আয়করের নথি খুলে দেখলেন, সেখানে বাড়ির কোনো উল্লেখই নেই। অনুসন্ধান করে এনবিআর আরও জানল, ঢাকায় এ রকম একাধিক বাড়ির মালিক তিনি। তাঁকে তলব করা হলে সেই ব্যবসায়ী বকেয়া সব কর একসঙ্গে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাড়ির সেই মালিকের নাম এবার পাওয়া গেল এনবিআরের সেরা করদাতার তালিকায়। এের কথাই বছরের পর বছর লিখতে হবে।
দুনিয়াজুড়েই এখন শীর্ষ ধনীদের তালিকা তৈরির একটি রেওয়াজ আছে। বিল গেটসের সম্পদ বাড়া বা কমার খবরের পাঠক কম নেই। এখন তো প্রতিদিনই ইলন মাস্ক বা জেফ বেজোসের সম্পদের ওঠানামার নানা তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। অনায়াসেই আমরা জানতে পারি পাশের দেশ ভারতের শীর্ষ ধনী কারা। কিন্তু বাংলাদেশে সবকিছুই গোপন। আয় বা সম্পদের প্রকৃত হিসাব দেওয়ার অর্থই হচ্ছে এর বিপরীতে কর দেওয়া হয়েছে। আর আমাদের এখানে সব চেষ্টাই যেখানে কর ফাঁকি দেওয়া, সেখানে সম্পদের হিসাব পাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। তাই প্রতিষ্ঠিত অনেক বড় ব্যবসায়ী কোনো অভিজাত তালিকাতেই স্থান পান না, পেতে সম্ভবত চানও না। যদিও অভিজাত জীবনযাপন তাঁদের খুবই পছন্দের। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছিলেন, ‘ধন জিনিসটাকে আমাদের দেশ সচেতনভাবে অনুভব করিতেই পারিল না, এই জন্য আমাদের দেশের কৃপণতাও কুশ্রী, বিলাসও বীভৎস (বোম্বাই শহর, পথের সঞ্চয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)’।
অর্থনীতিতে সাফল্য অনেক। অনেক ভালো উদ্যোক্তা আছেন, যাঁরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার এই দেশেই আশির দশকে ব্যাংক লুটপাটের যে কাহিনি শুরু হয়েছিল, এক এক যুগে তা আরও বেড়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটেছে দুবার। বাংলাদেশে একটি শ্রেণি বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়েছে মূলত এই দুই পথেই। এ ছাড়া ছিল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবসা বা কাজ পাওয়ার নানা পথ। সরকারের কাছের ব্যবসায়ীরা এখানে লাভজনক ব্যবসার সুযোগ পান, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করেন এবং কর ফাঁকি দেন। তাঁরা ধনী হয়েছেন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে, সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে। এ রকম এক পরিবেশ বজায় থাকলে জর্দা ব্যবসায়ী কাউছ মিয়া বা চট্টগ্রামের ফল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ কামালের কথাই বছরের পর বছর লিখতে হবে।