পাঁচ দশকের বাজেটের গল্প–১
টিকে থাকার দশক
উত্থান-পতনের মধ্যে ছিল স্বাধীন দেশের প্রথম দশকটি। শুরু হয়েছিল পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে। আকাঙ্ক্ষা ছিল আত্মনির্ভর হওয়ার। পথ বেছে নেওয়া হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোর। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ অর্থনীতির ৯০ শতাংশের বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছিল। তবে অনভিজ্ঞতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর দেশ চলে যায় সামরিক শাসনের কবলে। পরিবর্তন ঘটে অর্থনীতির নীতিরও। সমাজতান্ত্রিক কাঠামো থেকে সরে আসে দেশ। ব্যক্তি খাতের ওপর জোর দেওয়া হয়। অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে উদার করা হয়। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জনজীবনে স্বস্তি ছিল কম।
৫০ বছরে দেশে ৫০টি বাজেট দেওয়া হয়েছে। প্রথম পর্বে থাকছে প্রথম দশকের বাজেট নিয়ে পর্যালোচনা।
১. মুজিবনগর সরকার, ১৯ জুলাই ১৯৭১
প্রথম বাজেটটি দিয়েছিল মুজিবনগর সরকার। তখন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন এম মনসুর আলী। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এর অনুমোদন দিয়েছিলেন। সেই বাজেটের ব্যাখ্যামূলক টীকায় বলা ছিল, ‘আমাদের এখন স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য দরকারি, অপরিহার্য ব্যয় মেটাতে বাজেট তৈরি করতে হচ্ছে। যেটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধ প্রক্রিয়ায় সাহায্য করবে। বাজেট জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ১৯৭১—এই তিন মাস সময়ের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই আশায় এটা করা হয়েছে যে আমরা এই সময়ের মধ্যেই দেশকে স্বাধীন করতে পারব। অধিকাংশ সংগঠন সম্প্রতি স্থাপিত হয়েছে অথবা স্থাপিত হচ্ছে বিধায় বাজেট বরাদ্দ তৈরি করা হয়েছে কোন বাস্তব (নিরীক্ষা) ব্যতিরেকে।’ সেই বাজেটে আয় ধরা হয়েছিল ৭ কোটি ৭৪ লাখ ১৮ হাজার ৯৯৮ টাকা, ব্যয় ধরা হয় ৮ কোটি ৬২ লাখ ৪৮ হাজার ২০৪ টাকা। ফলে বাজেট ঘাটতি ছিল ৮৮ লাখ, ২৯ হাজার ২০৬ টাকা।
২. তাজউদ্দীন আহমদ, ৩০ জুন ১৯৭২
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একই সঙ্গে দুটি অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছিলেন। ১৯৭১-৭২ সালের বাজেটটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ের। এ নিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে আমরা বাংলাদেশের সম্পূর্ণ এলাকার কার্যক্ষম প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছি। তার আগে মুজিব নগরস্থিত বাংলাদেশ সরকার তখনকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক অনুমোদিত বাজেটের ভিত্তিতে সরকারের আর্থিক বিষয়াদির তত্ত্বাবধান করেছেন।’ আর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেটের শুরু ছিল ১ জুলাই ১৯৭২ সাল থেকে, শেষ ৩০ জুন ১৯৭৩। এ নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট মূলত পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন-ধর্মী। তবে সেই সঙ্গে শুরুতেই যাতে ভবিষ্যৎ শোষণহীন, সমাজতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি স্থাপিত হতে পারে, সেই কথা স্মরণে রেখেই আমরা অগ্রসর হয়েছি।’
ওই বাজেটের আয়-ব্যয়ের হিসাব ছিল একটি ভিন্ন ধরনের। যেমন, রাজস্ব আয় ধরা হয়েছিল ২৮৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, এবং ব্যয় ২১৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। আবার উন্নয়ন, পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বাসন বাজেট ঠিক করা হয়েছিল ৫০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি ছিল ৩১৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
৩. তাজউদ্দীন আহমদ, ১৪ জুন ১৯৭৩
জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত দেশের প্রথম বাজেট। এই অর্থবছর ছিল প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম বছর। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয় ৩৭৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা, আর ব্যয় ২৯৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অন্যদিকে এডিপির পরিমাণ ছিল ৫২৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী সমস্যার জটিলতা শিরোনামে একটি অধ্যায় যুক্ত করেছিলেন। সেখানে বলেছিলেন, ‘সমস্যার জটিলতা ও নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা এড়িয়ে আমাদের সাফল্য সম্পর্কে বাগ্মিতা করা অনায়াসসাধ্য। আমাদের ঔপনিবেশিক শাসকেরা এই পদ্ধতিই অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তু যে সরকার জনগণের, যে সরকার সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের বিরাট দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে জনগণের সমর্থন ও অংশগ্রহণের ওপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীল, সে সরকারের পক্ষে জনগণকে দেশের প্রকৃত অবস্থা জ্ঞাপন করা এক নৈতিক দায়িত্ব।’ আর উপসংহারে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘আমাদের উন্নয়নের প্রথম বৎসরে অর্থ ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন, জাতীয় পুনর্গঠন এবং খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্য সংগ্রহের জরুরি তাগাদায় আমরা বৃহৎ পরিমাণে বৈদেশিক সাহায্য নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। সাহায্যকারী দেশসমূহের কাছে আমরা ঋণী। কিন্তু তাঁদের প্রতি এবং নিজেদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব হলো এ কথা প্রতিপন্ন করা যে আন্তর্জাতিক সাহায্যের স্থায়ী প্রার্থী আমরা নই, প্রয়োজনীয় কষ্ট স্বীকার আমরা করতে প্রস্তুত এবং বৈদেশিক সাহায্যকে আমরা উৎপাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে প্রয়াসী। সকল স্তরে আমরা আয়ত্তাধীন ক্ষমতায় পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছি, এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরই শুধু নতুন বৈদেশিক সাহায্য সন্ধান করতে পারি। যাতে বৈদেশিক নির্ভরশীলতা ঘুচিয়ে আমরা অভ্যন্তরীণ সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে পারি, তেমন বিনিয়োগ প্রকল্প ও নীতি আমাদের গ্রহণ করা উচিত। সেই সঙ্গে রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হবে এবং আমদানি বিকল্পের বিকাশ সাধন করতে হবে।’
৪. তাজউদ্দীন আহমদ, ১৯ জুন ১৯৭৪
তাজউদ্দীন আহমদ দেশের একমাত্র অর্থমন্ত্রী, যিনি মূলত রাজনীতিবিদ ছিলেন। এই রেকর্ডটি এখনো তাঁর দখলে। তাঁকে শেষ বাজেটটি দিতে হয়েছিল চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে। জ্বালানি তেল ও ডলারকে কেন্দ্র করে ১৯৭৩ সালে বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছিল, দেশে তার প্রভাব পড়েছিল তীব্র ভাবে। আর এর প্রতিফলন ছিল বাজেট বক্তৃতায়। তিনি বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়ার তথ্য তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘যে ধারণার ভিত্তিতে আমরা অগ্রসর হতে চেষ্টা করেছি, প্রতিকূল আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও পরিবর্তিত দেশজ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তা অনেকখানি বিপর্যস্ত হয়েছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং পৃথিবীব্যাপী খাদ্যশস্যের পরিবহন চাহিদার জন্য জাহাজভাড়ারও অপ্রত্যাশিত বৃদ্ধি ঘটেছে। চলতি বছরে এমনও সময় গেছে যখন অধিক মূল্য দিতে স্বীকৃত হয়েও আমরা অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদির সরবরাহ সময়মতো অর্জন করতে সক্ষম হইনি। ঘাটতি অর্থ সংস্থানের কারণে মুদ্রা সরবরাহে স্ফীতির জন্য এবং অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত নিম্নতর উৎপাদন মাত্রার জন্য চলতি বছরে দ্রব্যমূল্য তীব্র ভাবে বেড়ে গেছে। মুদ্রাস্ফীতির এই প্রবল চাপ শুধু গণজীবনেই দুঃসহ বোধ হয়নি, উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের ব্যয়ও বাড়িয়ে তুলেছে।’
সবশেষে তিনি বলেছিলেন, ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি না ঘটলেও ১৯৭৩-৭৪ অর্থ বৎসর জাতির জন্য বাস্তবানুগ অভিজ্ঞতার কাল। উন্নয়নের উদ্দেশ্যে সর্বাত্মক প্রয়াসে জাতি সব পর্যায়ে অগ্রণী হয়েছিল কি না, তা তলিয়ে দেখা দরকার। সততা, নিয়মানুবর্তিতা, বাস্তবানুগ উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন ও কঠোর পরিশ্রমের আজ বড় প্রয়োজন। এ কথা মনে রাখা দরকার যে স্লোগান দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম হয় না, দুর্নীতি দূর হয় না, বুলি আউড়িয়ে প্রবৃদ্ধি আনা যায় না, জনসাধারণকে সর্বকালের জন্য ধোঁকা দেওয়া চলে না।’
রাজস্ব আয় ও রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের বাজেট ছিল সুষম বাজেট। আয় ধরা হয়েছিল ৪৭০ কোটি ২৩ লাখ টাকা, ব্যয়ও তাই। আর এডিপি ছিল ৫২৫ কোটি টাকার। এই বাজেট নিয়ে পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল, ‘৮৯ কোটি ১৪ লাখ টাকার নয়া কর ও কর বৃদ্ধির প্রস্তাব’।
৫. এ আর মল্লিক, ২৩ জুন ১৯৭৫
অর্থমন্ত্রীর বদল হয়েছে। পার করতে হয়েছে দুর্ভিক্ষের বছর। গঠিত হয়েছে বাকশাল, যাকে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন ও বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব। অর্থনীতিতেও কিছু পরিবর্তন আনা শুরু হয়েছে। কালোটাকা কমাতে এক শ টাকার নোট বাতিল করা হয়েছিল বাজেটের দুই মাস আগে। আবার ওই বছরের ১৭ মে পাউন্ডের বিপরীতে টাকার মান ৬০ শতাংশ কমানো হয়। আবার এই বাজেটেই বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা ২৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি করা হয়।
১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছিল ৭৫৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ও ব্যয় ধরা ছিল ৫৯৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা। আর এডিপির আকার ছিল ৯৫০ কোটি টাকা।
বাজেটের উপসংহারে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এই বাজেট সর্বপ্রকার জাতীয় সমস্যার সমাধান করিবে এই প্রতিশ্রুতি আমি দিতেছি না, তবে এই কথা আমি দৃঢ়প্রত্যয়ের সহিত বলিতে পারি যে আমরা উন্নয়ন কার্যক্রমের সর্বাঙ্গীণ সফলতার জন্য যে পদক্ষেপ গ্রহণে সচেষ্ট হইয়াছি, তাহা জাতিকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাইতে সাহায্য করিবে। ১৯৭৫-৭৬ সনের বাজেটের উদ্দেশ্য হইতেছে এমন একটি বাৎসরিক কর্মসূচী প্রণয়ন যাহা জনগণকে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করিবে, দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি রোধ করিবে, জাতীয় নীট সঞ্চয় বাড়াইবার জন্য প্রয়োজনীয় কৃচ্ছ্রসাধনায় উৎসাহিত করিবে এবং বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে সম্পদের এইরূপ বণ্টন নিশ্চিত করিবে যাহাতে সীমিত সম্পদের সর্বাধিক সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত জাতীয় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়’।
৬. মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, ২৬ জুন ১৯৭৬
জিয়াউর রহমান তখন সেনাবাহিনীর প্রধান ও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। একই সঙ্গে ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপদেষ্টা। বাজেট দেওয়া হয় রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে, বঙ্গভবন থেকে। ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয় ৯৬৬ কোটি চাকা, রাজস্ব ব্যয় ৭৬৮ কোটি টাকা এবং এডিপির আকার ছিল ১ হাজার ২২২ কোটি টাকা।
বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতার ন্যূনতম আয়করের সীমা ৮ হাজার ৪০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করা হয়। বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতের বৃহত্তর ভূমিকাকে শিল্পায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করা হয়। ১৯৭২ সাল থেকে আয়করের ওপর ১০ শতাংশ হারে সারচার্জ বহাল ছিল, সেটিও বাতিল করা হয়। পাশাপাশি ভূমি উন্নয়ন কর নামে নতুন কর তৈরি করা হয়। তবে ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ অব্যাহত রাখা হয়।
৭. মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, ২৫ জুন ১৯৭৭
প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান তখনো অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয় ১ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা, ব্যয় ৯০৬ কোটি টাকা। আর এডিপি ছিল ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এই অর্থবছর ছিল প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ বছর।
এই বাজেটেই ইতিহাসে প্রথমবারের কালোটাকা সাদা করার সুযোগের কথা বলা হয়। জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘আপনারা অবগত আছেন যে সরকার ৬ নং সামরিক আইনের অধীনে করদাতাদের তাঁদের কর-অনারোপিত আয়ের ঘোষণার জন্য ১৯৭৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু নানা কারণে অনেকে এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারেননি বলে আবেদন-নিবেদন বিবেচনা করে সরকার তাঁদের কর-অনারোপিত প্রকৃত আয়ের ঘোষণার জন্য এ বছর ৩০ জুন পর্যন্ত আর একবার সুযোগ দিয়েছেন। এতে কোনো রেয়াতি হারের সুযোগ দেওয়া হয়নি, কিন্তু দণ্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায় যে করদাতারা তাঁদের এখনো অপ্রকাশিত আয় ঘোষণার এই শেষ সুযোগ হারাবেন না, কেননা, এর পরে কর ফাঁকির কেসসমূহের ব্যাপারে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
৮. মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, ৩০ জুন ১৯৭৮
আবারও রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে বঙ্গভবনে বসে বাজেট উপস্থাপন করা হয়। বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ছিল ১ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা, ব্যয়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল ১ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। আর এডিপি ছিল ১ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। ১৯৭৮-৭৯ অর্থবছর ছিল দ্বিবার্ষিক-বার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম বছর।
আগের অর্থবছরে নতুন বেতন স্কেল কার্যকর করার কারণে বাজেটে ব্যয় অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এর ব্যাখ্যায় জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘সকল কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধি এবং অবসর গ্রহণকারীদের পেনশন বাবদ পর্যাপ্ত সুবিধাদি প্রদানের ফলে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। জাতি নিশ্চয়ই আশা করতে পারে যে চাকরিরত সকল কর্মচারীরা তাদের কর্তব্যনিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে এই অতিরিক্ত সুবিধাদির প্রতিদান দেবেন। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক এবং অন্যান্য সেক্টর করপোরেশনের কর্মচারীদের সম্বন্ধেও জাতি অনুরূপ আশা পোষণ করবে।’
৯. এম এন হুদা, ২ জুন ১৯৭৯
আবার সংসদে বাজেট উপস্থাপন। ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরের বাজেটে ১ হাজার ৮১২ কোটি টাকা আয়, ১ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা ব্যয় এবং ২ হাজার ১২৩ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট ঠিক করা হয়েছিল।
এই বাজেটে কর খাতের সংস্কারে একটি কর তদন্ত কমিশন গঠনের কথা উল্লেখ আছে। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ইতিমধ্যে কর তদন্ত কমিশন তাহাদের চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করিয়াছেন। কমিশনের সুপারিশসমূহ সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রহিয়াছে, তাহাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি সুপারিশ এ বৎসরের বাজেটের মাধ্যমে কার্যকর করার প্রস্তাব করা হইতেছে। সরকার অনুভব করেন যে দেশের কর রাজস্বসমূহের আরও বৃহত্তর অংশ প্রত্যক্ষ করগুলি হইতে আসা উচিত এবং তাই এ সমস্ত করের আদায় বাড়ানোর ওপর সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন।’
১০. মোহাম্মদ সাইফুর রহমান, ৭ জুন ১৯৮০
সংসদে উপস্থাপিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয় ২ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা, ব্যয় ১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা এবং এডিপির আকার ছিল ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। পরের দিন দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল, ‘উদ্বৃত্ত জাতীয় বাজেট: ১০০ কোটি টাকার নয়া কর প্রস্তাব: প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৭.৬ ভাগ’।
বাজেটে অর্থমন্ত্রী দেশের অর্থনীতির কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন আনার দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেছিলেন। আর এ জন্য তিনি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিশেষ পদক্ষেপের কথা বলেছিলেন। আর এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসাবে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে দেশব্যাপী খাল কাটা কর্মসূচির ওপর জোর দিয়েছিলেন।
বাজেটে তিনি ব্যাংকে প্রতি চেকের মাধ্যমে লেনদেনের ক্ষেত্রে শুল্ক ২০ পয়সা থেকে ২৫ পয়সা, আয় ২০ হাজার টাকার বেশি হলে আয়কর রিটার্নের সঙ্গে সম্পদ ও দায়বিবরণী বাধ্যতামূলক এবং সময়মতো রিটার্ন দাখিল না করলে বাধ্যতামূলক জরিমানা ধার্য করেছিলেন। তিনি বিদেশি মদ, চা-বাগান এলাকার দেশি মদ, স্পিরিট, গাঁজা ও মৃতসঞ্জীবণীর ওপর শুল্ক হারও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
১১. মোহাম্মদ সাইফুর রহমান, ৬ জুন ১৯৮১
জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহ পরই দেওয়া হয়েছিল ১৯৮১-৮২ অর্থবছরের বাজেট। বাজেটে ২ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা রাজস্ব আয়, ১ হাজার ৬৬২ কোটি রাজস্ব ব্যয় এবং ৩ হাজার ১৫ কোটি টাকার এডিপি নির্ধারণ করা হয়েছিল।
বাজেটে অর্থমন্ত্রী অকট্রর ডিউটি বা নগর শুল্ক নামে একটি কর প্রথা বাতিল করে দিয়েছিলেন। মিউনিসিপ্যাল এলাকায় পণ্য প্রবেশ করলে এই শুল্ক দিতে হতো। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এই শুল্কের ফলে জনসাধারণের নিত্যব্যবহার্য পণ্যাদির অবাধ চলাচল এবং বিপণনে নানা অসুবিধার কথা বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
বাজেটে কম্পিউটারের ওপর শুল্ক হার ১০০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়েছিল। অর্থের জোগান বাড়াতে সব শুল্কযুক্ত আমদানির ওপর ১ শতাংশ হারে উন্নয়ন সারচার্জ বসানো হয়। বাজেটে প্রথমবারের মতো স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে আয়কর রিটার্ন দেওয়ার প্রথা চালু করেছিলেন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে অপ্রদর্শিত আয় বা কালোটাকা সাদা করার সুযোগও দেওয়া হয়েছিল।
অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে আয়করের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো কর-ভিত্তির সংকীর্ণতা। কর ব্যবস্থার বাইরে থেকে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাই এর মূল কারণ। কর তদন্ত কমিশনও একই মত ব্যক্ত করেছেন। কর-ভিত্তি প্রসারের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জনসাধারণের পরিপূর্ণ সহযোগিতা ছাড়া এই অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতিসাধন সম্ভব নয়। জনসাধারণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কর-ভিত্তিকে প্রসারিত করার জন্য এবং কর-সংক্রান্ত আইন-কানুন পালনের জটিলতা থেকে করদাতাদের রেহাই দেওয়ার এবং একই সঙ্গে কর নির্ধারণের বকেয়া কাজ ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে আমি আয়কর স্বয়ং নির্ধারণ (সেল্ফ অ্যাসেসমেন্ট) পদ্ধতি প্রবর্তন করার প্রস্তাব করছি। আয়কর আইনে বর্ণিত সকল ব্যক্তিগণ যাঁরা মওকুফ-সীমার ঊর্ধ্বে এবং অনূর্ধ্ব পঁচিশ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় দেখিয়ে রিটার্ন দাখিল করবেন, তাঁরাই এই স্কিমের আওতায় আসবেন। মোট আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি যাঁরা বেতন থেকে পান তাঁদের ক্ষেত্রে এই সীমা প্রযোজ্য হবে না। যেসব করদাতা ব্যবসা বা পেশা থেকে আয় লাভ করে থাকেন, তাঁদের রিটার্নের সঙ্গে লাভ-লোকসানের হিসাব এবং ব্যালেন্স শিটের কপি থাকতে হবে। যাঁরা হিসাবে রাখেন না, তাঁদের আয়-ব্যয়ের হিসাবসহ নির্ধারিত ফার্মে সম্পদের বিবরণী দাখিল করতে হবে। ব্যবসার আয়ের করদাতাগণকে পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে কমপক্ষে শতকরা দশ ভাগ আয় বেশি দেখাতে হবে। লোকসান অথবা সর্বশেষ নির্ধারিত আয় অপেক্ষা কম আয় দেখানো রিটার্নসমূহ এই স্কিমের সুবিধা পাবে না। নতুন-পুরাতননির্বিশেষে সকল করদাতাই আয়কর স্বনির্ধারণের সুযোগ পাবেন। এই স্কিম শুধু ১৯৮১-৮২ এবং পরবর্তী কর বছরগুলোর জন্যই প্রযোজ্য হবে না, উপরন্তু যেসব ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী বছরগুলোর কর নির্ধারণ এখনো সম্পন্ন হয়নি সেসব ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। সঠিক আয় দেখিয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৮১ সালের মধ্যে কর প্রদানের চালানসহ রিটার্ন অথবা সংশোধিত রিটার্ন দাখিল করলে করদাতাগণ এই সুবিধা পাবেন। এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগকারী নতুন করদাতাগণও যদি তাঁদের পুঁজির কমপক্ষে এক-চতুর্থাংশ নীট আয় দেখান, তা হলে তাঁরাও এই সুযোগ নিতে পারবেন। এইরূপ পুঁজি বিনিয়োগের উৎস সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা হবে না। অন্যান্য ক্ষেত্রে আয় অথবা পরিসম্পৎ গোপনকারী ব্যক্তিরা এই স্কিমের সুবিধা পাবেন না। তাঁদের ক্ষেত্রে ফাঁকি দেওয়া করের পাঁচগুণ পরিমাণ জরিমানা করা যাবে এবং সমাপ্ত অ্যাসেসমেন্টগুলো যেকোনো সময় পুনরায় খোলা যাবে।’