ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক
কাজ শুরুর আগেই ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ
২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ উড়ালসড়কে অর্থায়ন করছে চীন। চীনের নানা শর্তের কারণে প্রকল্প অনুমোদনের পাঁচ বছর পরও কাজ শুরু হয়নি।
ঢাকার যানজট কমাতে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে সাভারের ইপিজেড পর্যন্ত উড়ালসড়ক আগামী জুনে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা। প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সরকারি নথিতে এমন তথ্যই রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়কের একটি পিলারও এখনো দৃশ্যমান হয়নি। অথচ একই সময়ে শুরু হওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পটি আগামী জুনে চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা রয়েছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলও এ বছরের ডিসেম্বরে চালুর কথা রয়েছে।
ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয় ২০১১ সালে। এরপর কেটে গেছে এক দশক। এ সময়ে উড়ালসড়কটির বাস্তব অগ্রগতি শূন্য। কিন্তু ৯ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ১৭ হাজার ১৬৩ কোটি টাকায় ঠেকেছে। কাজ শুরু না হলেও বাড়তি ব্যয়ের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে সেতু বিভাগ। একই সঙ্গে আগামী জুনের পরিবর্তে প্রকল্পের মেয়াদ আরও চার বছর বাড়িয়ে ২০২৬ পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেতু বিভাগের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করছে পরিকল্পনা কমিশন। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, কাজ শুরুর আগেই প্রায় দ্বিগুণ খরচ বেড়েছে প্রকল্পটির। ২০২৬ সাল নাগাদ সেই খরচ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা-ই এখন দেখার বিষয়।
নির্ধারিত সময়ে ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়কের কাজ শুরু না হওয়ায় উড়ালসড়কটি নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি খরচ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৭১৫ কোটি টাকা। শুরুতে যা ছিল ৪০০ কোটি টাকা। ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়কের সঙ্গে কক্সবাজারের সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের একটা সম্পর্ক আছে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরের সময় সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটিতে চীনের সঙ্গে চুক্তির কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটি দেশের চাপে চুক্তিটি আর হয়নি। সোনাদিয়ার পরিবর্তে ওই বছরই আলোচনায় আসে ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক প্রকল্পটি। সোনাদিয়ার পরিবর্তে ঢাকা-আশুলিয়া প্রকল্পে ঋণ দিতে রাজি হয় চীন সরকার। তবে উড়ালসড়কটি নির্মাণে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) বিনা দরপত্রে কীভাবে কাজটি পেল, সেটি এখনো রহস্যময়।
গলদ কোথায়?
ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেয়েছিল ২০১৭ সালে। প্রশ্ন হলো, অনুমোদন পাওয়ার চার বছরেও কেন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, এ প্রকল্পে অর্থায়নকারী চীন থেকে বরাবরই অসহযোগিতা পেয়ে আসছে সেতু বিভাগ। কখনো জমি অধিগ্রহণের নথি, কখনো ক্ষতিপূরণের কাগজপত্র, কখনো পথ নির্ধারণের নথি চাওয়ার নামে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, যেকোনো নথি পাঠালে দেশটি থেকে সাড়া মিলে দেরিতে। যেসব নথি জরুরি নয়, সেসবও চাওয়া হতো। এসব আনুষ্ঠানিকতার নামে অনেক সময় অপচয় হয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর দেড় বছর যোগাযোগবিচ্ছিন্ন ছিল চীনের সঙ্গে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট তথ্য থেকে জানা যায়, প্রথমে সিদ্ধান্ত ছিল উড়ালসড়কটির পুরো অর্থ চীন সরকার দেবে। জমি অধিগ্রহণসহ অন্য কাজের অর্থায়ন করবে বাংলাদেশ সরকার। পরে সিদ্ধান্ত বদল করে চীন জানায়, ৮৫ শতাংশ অর্থ দেবে দেশটির এক্সিম ব্যাংক। বাকি ১৫ শতাংশ অর্থ বাংলাদেশ সরকারকে বহন করতে হবে। এ শর্ত নিয়েও অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। নতুন শর্ত অনুযায়ী, মোট প্রকল্প ব্যয়ের ১৭ হাজার ১৬৩ কোটি টাকার মধ্যে চীন সরকার ঋণ দেবে ৯ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। বাকি ৭ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারকে দিতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, চীনের টাকায় বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো দেরি হওয়ার প্রধান কারণ, দেশটি নথিপত্র অনুমোদন করতে সময় নেয় বেশি। চাইলেই কম সময়ে এসব কাজ করা যায়। এ জন্য অর্থায়নকারী এক্সিম ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
উড়ালসড়কের পথ নিয়েও আছে জটিলতা
প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, উড়ালসড়কটি শুরু হবে রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা থেকে। সেখান থেকে আবদুল্লাহপুর হয়ে ধেউর-আশুলিয়া, বাইপাইল হয়ে সাভার রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) গিয়ে শেষ হবে। তবে এ পথ নির্ধারণ নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। বিমানবন্দর এলাকায় যেখান থেকে উড়ালসড়কটি শুরু হবে, সে জায়গাটি বাংলাদেশ রেলওয়ের। সেখানে বিমানবন্দরের রেলস্টেশন আছে। রেলের জমি পেতে আলোচনা চলছে দুই পক্ষের মধ্যে। আবার উড়ালসড়কটির প্রস্তাবিত পথ পড়েছে র্যাব সদর দপ্তরের একাংশেও। সেটি নিয়েও আলোচনা চলছে।
অনেক সময়ক্ষেপণের পর গত ২৬ অক্টোবর চীনের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ইআরডির ঋণ চুক্তি সই হয়েছে। তবে আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ঋণ চুক্তির কার্যকারিতা শুরু হয়নি। ফলে কবে নাগাদ দেশটির ঋণছাড় শুরু হবে, তা নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা।
ব্যয় বাড়ল যেভাবে
সিএমসির সঙ্গে সেতু কর্তৃপক্ষের সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল ২০১৫ সালে। উড়ালসড়কটি নির্মাণের জন্য তখন সিএমসি ১১৩ কোটি ডলারের বাণিজ্যিক প্রস্তাব দেয় সেতু বিভাগকে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৬০৫ টাকা। অবশ্য ওই প্রস্তাবে বিদ্যমান আশুলিয়া সড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণ এবং তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দুটি সেতু ছিল না।
২০১৬ সালে সেতু বিভাগ আলাদা একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে। কারিগরি কমিটি ২০১৭ সালে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। সে কমিটি প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করে ১২৯ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবটি প্রয়াত প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সামনে তুলে ধরা হয়। ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, নতুন প্রস্তাবে আশুলিয়া সড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণ এবং তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দুটি সেতু যুক্ত করা হয়েছে। ইপিজেড থেকে উড়ালসড়কে ওঠানামার জন্য দুটি র্যাম্পসহ একটি আন্ডারগ্রাউন্ড ইউলুপ নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এরপর ২০১৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির বা একনেক সভায় অনুমোদনের সময় প্রকল্পটির ব্যয় বাড়িয়ে ১৬ হাজার ৯০১ কোটি টাকা নির্ধারণ করে সেতু বিভাগ। সে ব্যয় এখন ১৭ হাজার ১৬৩ কোটি টাকায় ঠেকেছে। যদিও এখনো প্রকল্পের কাজই শুরু হয়নি। তবে জমি অধিগ্রহণ শেষ।
জানতে চাইলে ঢাকা–আশুলিয়া উড়ালসড়ক প্রকল্পের পরিচালক শাহাবুদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, একেক সময়ে একেক নথি চেয়ে এত বছর সময় নষ্ট করেছে চীন। পরে এসে ঋণের পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছে। উড়ালসড়ক প্রকল্পে যেহেতু বড় অংশ ঋণ দিচ্ছে, দেশটি সে কারণে তাদের বিলম্বের কারণে কাজ এগোয়নি। তিনি বলেন, এ ধরনের সমস্যা সমাধানে দরকার কূটনৈতিক তৎপরতা। এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ নিয়ে উন্নয়ন-সহযোগীদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর সময় এসেছে বলেও জানান তিনি।