বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রোকিয়া আফজাল রহমান আর নেই
দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রোকিয়া আফজাল রহমান আর নেই। গতকাল বুধবার ভোররাতে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
বর্ণাঢ্য জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন রোকিয়া আফজাল রহমান। ষাটের দশকে ব্যাংকার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন করাচিতে। তিনিই পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম নারী ব্যাংক ম্যানেজার। আশির দশকে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে কৃষি ব্যবসায় নামেন। গত চার দশকে অন্যান্য ব্যবসার পাশাপাশি একাধিক ব্যবসায়ী সংগঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশে নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
আরলিঙ্কস গ্রুপের চেয়ারম্যান রোকিয়া আফজাল রহমান। এই গ্রুপের ব্যবস্থাপক খালেদ সাইফুল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রোকিয়া আফজাল রহমান অনেক দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। বিশেষ করে কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তখন থেকেই সিঙ্গাপুরে তাঁর চিকিৎসা চলছিল।
খালেদ সাইফুল্লাহ আরও বলেন, এক মাসে আগে রোকিয়া আফজাল রহমান দেশে আসেন। দুদিন আগেও তিনি মাইডাস ফাইন্যান্সের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে অংশ নেন। কিন্তু মঙ্গলবার তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে জরুরি ভিত্তিতে তাঁকে আবার সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার মাউন্ট এলিজাবেথ নোভেনা হাসপাতালে বুধবার বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে চারটার দিকে ঘুমের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়।
রোকিয়া আফজাল রহমানের জন্ম ১৯৪১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে কলকাতা ও করাচিতে। ১৯৬২ সালে করাচিতে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকে (বর্তমানে রূপালী ব্যাংক) যোগ দেওয়ার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় ব্যাংক ম্যানেজার হয়ে আসেন। ব্যাংকার থাকার সময়েই সিলেটের এক চা-বাগানের ব্যবস্থাপক আজিমুর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮০ সালে হিমাগারের ব্যবসায় নামেন। প্রতিষ্ঠা করেন আর আর কোল্ড স্টোরেজ। পরে মুন্সিগঞ্জের ঈমান কোল্ড স্টোরেজ কেনেন। এরপর অন্যান্য ব্যবসায়ও যুক্ত হন।
মৃত্যুর আগে রোকিয়া আফজাল রহমান মিডিয়া ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের চেয়ারপারসন ছিলেন। মিডিয়া ওয়ার্ল্ড থেকে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশিত হয়। একই সঙ্গে তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান মাইডাস ফাইন্যান্সের চেয়ারপারসন, মিডিয়াস্টার ও এবিসি রেডিওর পরিচালক ছিলেন। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যান্ড সার্ভিসেসের (মাইডাস) পরিচালক পদে ছিলেন।
বাংলাদেশ নারী উদ্যোক্তা ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন রোকিয়া আফজাল রহমান। ২০১৩-১৪ সময়ে তিনি মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ঢাকা (এমসিসিআই)–এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনেরও সভাপতি ছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্র্যাকের পরিচালনা পর্ষদেও দায়িত্ব পালন করেন এই সফল নারী উদ্যোক্তা। এ ছাড়া প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের প্রতিষ্ঠাকালীন পর্ষদ সদস্য ছিলেন তিনি। ২০১২ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত দুই মেয়াদে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন রোকিয়া আফজাল রহমান।
রোকিয়া আফজাল রহমানের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি তাঁর পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এক শোকবার্তায় বলেছেন, ‘নারীদের আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত হয়ে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে সচেষ্ট ছিলেন রোকিয়া আফজাল রহমান। তাঁর জীবন, আদর্শ এবং কর্ম নারী জাগরণে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক শোকবার্তায় লিখেছেন, মানবিক সমাজ বিনির্মাণে সব সময় সচেষ্ট ছিলেন রোকিয়া আফজাল রহমান।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এক শোকবার্তায় বলেন, ‘টিআইবির দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনে রোকিয়া আফজাল রহমানের সক্রিয় ও সাহসী অংশগ্রহণ অনুকরণীয়। তাঁর সুচিন্তিত দিকনির্দেশনা আমরা কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। একজন কর্মনিষ্ঠ ও দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে তিনি আমাদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।’
আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রোকিয়া আফজাল রহমানের মরদেহ ঢাকায় এসে পৌঁছাবে। কাল শুক্রবার বাদ আসর গুলশান আজাদ মসজিদে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। বনানী কবরস্থানে দাফন হবে। তার আগে শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত গুলশানের বাসভবনে তাঁকে শেষশ্রদ্ধা জানাতে পারবেন বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে এমনটাই জানিয়েছেন রোকিয়া আফজাল রহমানের ছেলে ইমরান ফাইজ রহমান।