চিনির শুল্কায়ন এত কম কেন
প্রতি কেজি চিনির কাঁচামালের শুল্কায়ন করা হয় ৭০-৭২ টাকায়। অন্যদিকে প্রস্তুত চিনির কিছু চালান শুল্কায়ন করা হয়েছে ৬৩ টাকায়।
অপরিশোধিত চিনি পরিশোধন কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়ার উপযোগী চিনি তৈরি করে কোম্পানিগুলো। কিন্তু এই অপরিশোধিত চিনি যে দরে আমদানি হয়, তার চেয়ে ‘অস্বাভাবিক কম’ দামে পরিশোধিত বা খাওয়ার উপযোগী চিনি আমদানি দেখাচ্ছেন এর আমদানিকারকেরা। কাস্টমসও অনেক চালানে পরিশোধিত চিনির শুল্কায়ন করছে অপরিশোধিত চিনির চেয়ে কম মূল্যে! কম দরে প্রস্তুত চিনি আমদানি দেখিয়ে শুল্কায়নের কারণে বিপাকে পড়ছে পরিশোধন কারখানাগুলো।
চিনিতে টনপ্রতি কাস্টমস শুল্কের পাশাপাশি শুল্কায়ন মূল্যের নির্ধারিত হার অনুযায়ী শুল্ক-কর আদায় করা হয়। এর অর্থ শুল্কায়ন মূল্য কম হলে রাজস্বও কমে যায়।
কাঁচামাল ও প্রস্তুত চিনি আমদানির কয়েকটি চালান বিশ্লেষণে শুল্কায়নের অসামঞ্জস্য ধরা পড়ে। এ মাসে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা দুটি চালানে প্রতি টন কাঁচামাল যথাক্রমে ৬৪০ ও ৬৫৭ ডলার দাম দেখানো হয়েছে। এতে প্রতি কেজি চিনির কাঁচামালের দাম পড়ে ৭০-৭২ টাকা। এ দরে শুল্কায়ন করেছে কাস্টমস। তাতে প্রতি কেজিতে শুল্ক-কর নেওয়া হয়েছে ৪০-৪১ টাকা।
এবার দেখা যাক তৈরি মানে পরিশোধিত চিনির আমদানিতে কী ঘটছে। এ মাসেই একটি চালানে প্রতি টন পরিশোধিত চিনির আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে ৪৪৩ ডলার। তাতে প্রতি কেজি চিনির দাম পড়ে ৪৮ টাকা। ভারত থেকে আনা এই চিনির দর অস্বাভাবিক কম হওয়ায় কাস্টমস শুল্কায়ন মূল্য বাড়িয়ে টনপ্রতি ৫৮০ ডলার বা কেজিপ্রতি ৬৩ টাকা নির্ধারণ করেছে। এতে প্রতি কেজিতে শুল্ক-কর দিতে হয়েছে ৪৫ টাকা। গত মাসেও পরিশোধিত চিনির কয়েকটি চালান টনপ্রতি সাড়ে ৪০০ ডলারের কমবেশিতে আমদানি হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তখন শুল্কায়ন করা হয় ৫৮০ ডলার।
বিশ্ববাজারে চিনির কাঁচামাল ও প্রস্তুত চিনির দাম বাড়ছে। অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে তার ধারাবাহিক প্রতিফলন ঘটলেও প্রস্তুত চিনির ক্ষেত্রে অনেক চালানে তা দেখা যায় না।
এ নিয়ে জানতে চাইলে চিনি প্রক্রিয়াজাতকারী শিল্পকারখানাগুলোর সংগঠন সুগার রিফাইনারি অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখন যে চিনির কাঁচামাল তথা অপরিশোধিত চিনি আসছে, তা টনপ্রতি ৬৫৮ ডলার দরে আমদানি হচ্ছে। এর চেয়ে কম দরে পরিশোধিত চিনি আমদানি ও শুল্কায়ন হলে এই শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে।
কাস্টমসের তথ্যে দেখা যায়, প্রস্তুত চিনি আমদানিতে অনেক চালান টনপ্রতি ৬৬০ থেকে ৭৫০ ডলার দর ঘোষণা করেছেন অনেক আমদানিকারক। অর্থাৎ কিছু চালানে কম দর ঘোষণা করা হলেও অনেক চালান প্রকৃত দরে আমদানি হয়েছে। যেমন গত মাসে ভারত থেকে টনপ্রতি ৬৩০ কিংবা ৭৫০ ডলার দরেও তৈরি চিনি আমদানি হয়েছে।
এদিকে বিষয়টি সম্পর্কে চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার মো. বদরুজ্জামান মুন্সি গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, অপরিশোধিত চিনির চেয়ে পরিশোধিত চিনির শুল্কায়ন মূল্য বেশিই রয়েছে। তবে পরিশোধিত চিনির কিছু চালান আমদানি হয়েছে ৪৫০ ডলারের কমবেশি দরে, যেগুলো অনেক আগে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল। এরপরও শুল্ক মূল্যায়ন বিধিমালা অনুযায়ী শুল্কায়ন মূল্য বাড়ানো হয়েছে। যেমন টনপ্রতি ৪৪৩ ডলার দরে আনা চিনিতে ১৪৩ ডলার বাড়িয়ে শুল্কায়ন মূল্য ৫৮০ ডলার করা হয়েছে। এই দরের সঙ্গে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা চিনির দর মেলানো ঠিক হবে না। একই পণ্যের দেশভেদে শুল্কায়ন মূল্য ভিন্ন হতে পারে।
তবে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন গত মে মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে আন্তর্জাতিক মূল্য যাচাই করে পরিশোধিত চিনির শুল্কায়ন মূল্য নির্ধারণের অনুরোধ জানায়। চিঠিতে তারা জানায়, বিশ্ববাজারে চিনির কাঁচামাল টনপ্রতি ৬০০-৭০০ ডলার এবং পরিশোধিত চিনির দাম ৭৫০ ডলার।
দেশে চিনি পরিশোধনের পাঁচটি কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে মূলত চারটি প্রতিষ্ঠান। এই চার প্রতিষ্ঠান হলো মেঘনা সুগার রিফাইনারি, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, এস আলম রিফাইনড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ ও দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড।
দেশে চাহিদার তুলনায় চিনি উৎপাদন হয় কমবেশি ১ শতাংশ। এখন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় কমবেশি ৩০ হাজার টন। আমদানি হয় ২২-২৪ লাখ টন। মূলত অপরিশোধিত আকারে চিনি আমদানি হয় বেশি। অপরিশোধিত চিনি বা কাঁচামাল এনে প্রক্রিয়াজাত করে চিনি উৎপাদন করে করে পরিশোধন কারখানাগুলো। আর ওষুধ কোম্পানি ছাড়া ২৫-২৭টি খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াজাত ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত চিনি আমদানি করে।