ভর্তুকি মূল্যের পণ্য নিয়ে গরিব এলাকায় যায় না টিসিবির ট্রাক
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে ট্রাকে করে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি করছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। রাজধানীর স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত কার্যক্রমের ২৪ দিনের মধ্যে ১৯ দিন মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক ও বক চত্বরে এবং ১৪ দিন সচিবালয়ের ১ ও ৩ নম্বর ফটকের সামনে পণ্য বিক্রি করেছে টিসিবির ট্রাক। তবে এক দিনের জন্যও পণ্য নিয়ে যায়নি কড়াইল বস্তি কিংবা কামরাঙ্গীরচরের মতো নিম্ন আয়ের মানুষ-অধ্যুষিত এলাকায়।
টিসিবি থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এক দিনে রাজধানীর সর্বোচ্চ ৩০টি জায়গায় পণ্য নিয়ে যায় টিসিবির ট্রাক। এখন পর্যন্ত শহরের ১৭২টি স্থানে ট্রাকে পণ্য বিক্রি করা হয়েছে। এর মধ্যে ট্রাক সবচেয়ে বেশিবার গেছে ব্যাংকপাড়া মতিঝিল ও সচিবালয়–সংলগ্ন এলাকায়। নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস বেশি, এমন অনেক এলাকা টিসিবির এই কর্মসূচি থেকে হয় একেবারে বাদ পড়েছে, অথবা সেসব এলাকায় ট্রাক গেছে হাতে গোনা কয়েক দিন। দেখা গেছে, জোগানের তুলনায় পণ্যের চাহিদাও অনেক বেশি।
টিসিবির ট্রাক থেকে একজন ক্রেতা দুই কেজি করে মসুর ডাল, আলু ও পেঁয়াজ এবং দুই লিটার সয়াবিন তেল কিনতে পারছেন। তবে গতকাল মগবাজার, কারওয়ান বাজার ও মহাখালী বাজারের সামনে আলু বিক্রি করতে দেখা যায়নি।
সারা দেশে কার্ডধারী এক কোটি পরিবারের কাছে মাসে একবার ভোজ্যতেল, চাল, মসুর ডাল, চিনি ও পেঁয়াজের মতো পণ্য বিক্রি করে টিসিবি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে প্রায় ১৩ লাখ পরিবার এই কার্ড পেয়েছে। পরিবার কার্ড চালুর আগে টিসিবি ট্রাকে করেই পণ্য বিক্রি করত। ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে গত বছরের মাঝামাঝি ট্রাকে পণ্য বিক্রি বন্ধ করা হয়। তবে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলে গত ১৩ নভেম্বর টিসিবি আবার ট্রাকে করে পণ্য বিক্রির পুরোনো পদ্ধতিতে ফিরে আসে। লক্ষ্য ছিল, নিম্ন আয়ের দুই লাখ মানুষকে এই সুবিধা দেওয়া হবে। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষ এই সুবিধা কতটা পাচ্ছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
গতকাল সরেজমিনে কড়াইল বস্তি ঘুরে জানা গেছে, পরিবার কার্ড চালুর আগে সেখানে টিসিবির ট্রাক যেত। কিন্তু এখন আর টিসিবির ট্রাক সেখানে যাচ্ছে না। তবে সরকারের আরেকটি সহায়তা কর্মসূচি খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল ও আটা বিক্রির ট্রাক কড়াইলে যায়। ঢাকার অন্যতম বড় এই বস্তিতে কিছুসংখ্যক পরিবার টিসিবির কার্ড পেয়েছে। তবে এই কার্ড পেতে সুবিধাভোগীকে স্থানীয় এলাকার ভোটার হতে হয়। তাই বস্তিবাসীর তুলনায় পরিবার কার্ডধারীর সংখ্যা কম।
কড়াইল বস্তিতে কমবেশি ৪০ হাজার পরিবারের বাস। এ হিসাব স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। এক পরিবারে চারজন করে সদস্য ধরলে এ বস্তিতে বসবাস দেড় লক্ষাধিক মানুষের। এঁদের সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। বেলতলার একটি স্টেশনারি দোকানের স্বত্বাধিকারী মো. রিপন শিকদার প্রথম আলোকে জানালেন, তিনি টিসিবির কার্ড পাননি। ছোট দোকান থেকে তাঁর যে আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালাতে তাঁকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
রিকশাচালক সুজা মিয়া পরিবার নিয়ে থাকেন কড়াইলের টিঅ্যান্ডটি কলোনি এলাকার বস্তিতে। শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ীর ভোটার হওয়ায় পরিবার কার্ড পাননি তিনি। সুজা মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাক কড়াইলে না আসায় ও পরিবার কার্ড না থাকায় গত এক বছরে একবারও টিসিবির পণ্য কিনতে পারেননি। স্থানীয় কাউন্সিলর যখন টিসিবির কার্ড দিচ্ছিলেন, তখন যোগাযোগ করলেও লাভ হয়নি।
কোথায় বেশি যায়
টিসিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সংস্থাটি এমন সব এলাকায় ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি করছে, যেখানে নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস তুলনামূলক কম। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে মতিঝিল, পল্টন, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, নিউমার্কেট, মিরপুর ও উত্তরা। এমনকি ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকার দুটি জায়গায় টিসিবির ট্রাক গেছে ১৮ বার। আর টিসিবির প্রধান কার্যালয় কারওয়ান বাজারের আশপাশে কম দূরত্বের মধ্যে একাধিক স্থানে ২৫ বার ট্রাকের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা হয়েছে। অথচ জুরাইন, রায়েরবাগ ও ডেমরার মতো এলাকায় টিসিবির ট্রাক গেছে মাত্র এক থেকে দুবার।
এ ছাড়া যেসব স্থানে টিসিবির ট্রাক বেশিবার গেছে, তার মধ্যে রয়েছে কুড়িল বিশ্বরোডে ১৩ বার এবং ভিক্টোরিয়া পার্ক, মহাখালী কাঁচাবাজার, শাহজাদপুর বাজার ও প্রেসক্লাবের পাশে ১১ বার। মিরপুর ইসিবি চত্বর, উত্তরা আজমপুর কাঁচাবাজার, আগারগাঁও ৬০ ফিট রোড, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, ঢাকা মেডিকেলের সামনে এবং নদ্দা বাসস্ট্যান্ডে ট্রাক গেছে ১০ বার। এ ছাড়া ৪৮ জায়গায় টিসিবির ট্রাক গেছে পাঁচের অধিকবার। অর্থাৎ ঘুরেফিরে অনেকটা একই জায়গায় যাচ্ছে টিসিবির ট্রাক। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আশপাশে থাকা পথচারীরা পণ্য কেনার সুযোগ পাচ্ছেন।
টিসিবির ট্রাক গরিব হিসেবে পরিচিত এলাকায় যাচ্ছে না অথবা কম যাচ্ছে কেন—এমন প্রশ্নে টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ূন কবির প্রথম আলোকে বলেন, যেসব জায়গায় ট্রাক যাচ্ছে না, সেসব এলাকায় আগে পর্যাপ্তসংখ্যক পরিবার কার্ড দেওয়া হয়েছে। আর ট্রাকের পণ্য এক জায়গায় না দিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি কেউ যেন একাধিকবার পণ্য না নিতে পারেন, সে জন্য কবে, কোথায় ট্রাক যাবে, তা আগে থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় না। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর পাশাপাশি সাধারণ পথচারীরা টোকেন দিয়ে পণ্য কেনার সুযোগ পাচ্ছেন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশা মনে করেন, পণ্য বিক্রির জন্য তুলনামূলক সহজ জায়গায় না গিয়ে, বরং নিম্ন আয়ের মানুষকে লক্ষ্য করে টিসিবির কর্মসূচি চালাতে হবে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতেই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বেশির ভাগ গ্রামকেন্দ্রিক। শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উপলক্ষ করে বিশেষ কোনো কর্মসূচি সেভাবে নেই। এর মধ্যে সামান্য যেসব কার্যক্রম চলছে, সেগুলো অন্তত বস্তি কেন্দ্র করে হওয়া উচিত।’
সায়মা হক বিদিশা আরও বলেন, এসব কর্মসূচিতে বিক্রি হওয়া পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ানো উচিত। মূল্যস্ফীতির আলোকে কর্মসূচির আওতাও বাড়াতে হবে। প্রকৃত গরিবদের অগ্রাধিকার দিয়ে কর্মসূচির পরিকল্পনা করতে হবে। পণ্য পেতে মানুষের ভোগান্তি কমানোরও তাগিদ দেন এই অর্থনীতিবিদ।