দেশের পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। গত জুনে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হওয়ার পরে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বলেছিল, পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য হলো রপ্তানি কমেছে ৫ শতাংশ। আর বাংলাদেশ ব্যাংক গত সপ্তাহে জানিয়েছে, ইপিবির দেওয়া হিসাবের চেয়ে পণ্য রপ্তানির আয় ১ হাজার ১৯৮ কোটি বা ১২ বিলিয়ন ডলার কম এসেছে। এতে রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যান নিয়ে আবার নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
দেশে পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে থাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা ইপিবি। যদিও তারা পণ্য রপ্তানির প্রাথমিক তথ্য এনবিআর থেকে সংগ্রহ করে। আর আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে রপ্তানি আয় কত এল, সেই তথ্য জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য। সেই হিসাবে ২০২২–২৩ অর্থবছরে রপ্তানি বেড়েছে ৩৪৭ কোটি ডলার।
ইপিবি পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির তথ্য দিলেও এনবিআরের পরিসংখ্যান বলছে উল্টো কথা। পণ্য রপ্তানির শুল্কায়ন মূল্য ধরে হিসাব করে থাকে এনবিআর। সংস্থাটি আবার এই হিসাব করে টাকায়। যেমন গত ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৪ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার পণ্য। ওই অর্থবছরে প্রতি ডলারের গড় বিনিময় মূল্য ছিল ৮৬ দশমিক ৩০ টাকা (ইপিবির হিসাব)। সেই হিসাবে ওই অর্থবছরে রপ্তানি আয় এসেছে ৪ হাজার ৯১৩ কোটি ডলার। অন্যদিকে সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই অর্থবছরে প্রতি ডলারের গড় বিনিময় মূল্য ৯৯ দশমিক ৪৪৫ টাকা ধরে রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬৫৯ কোটি ডলার। তার মানে, এনবিআরের হিসাবে আগের বছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি কমেছে ২৫৪ কোটি ডলার বা ৫ শতাংশ।
শুধু ডলারের হিসাবে নয়, পণ্য রপ্তানির পরিমাণও কমেছে। এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি হয় ৬০ লাখ ১৮ হাজার টন। তার আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬৭ লাখ ৭৯ হাজার টন। সেই হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি কমেছে সাড়ে সাত লাখ টন বা ১১ শতাংশ।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ৪ হাজার ৩৫৭ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় এসেছে। এর আগের অর্থবছর এসেছিল ৪ হাজার ৩৬০ কোটি ডলার। এর মানে শেষ অর্থবছর রপ্তানি আয় কমেছে ৩ কোটি ডলার।
ইপিবি, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক—এই তিন সংস্থার তৈরি পণ্য রপ্তানি ও রপ্তানি আয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পণ্য রপ্তানি কম হলে দেশে আয়ও কম আসে। ইপিবির ২০২২–২৩ অর্থবছরের হিসাব আমলে নিলে দেখা যায়, ১ হাজার ১৯৮ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় দেশে আসেনি। আর এনবিআরের তথ্য আমলে নিলে ৩০২ কোটি ডলার দেশে আসেনি। একইভাবে হিসাব করলে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে আসেনি ৫৫৩ কোটি ডলারের রপ্তানি আয়।
ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও ইপিবির তৈরি রপ্তানি হিসাবের এই পার্থক্য কোনো দিন ঘুচবে না। কারণ, পণ্য জাহাজে ওঠার পরই আমরা হিসাব করি যে রপ্তানি হয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক হিসাব করে, ব্যাংকে রপ্তানি আয় আসার পর। অন্যদিকে অনেক সময় জাহাজভর্তি পণ্য ফেরত আসে, যা এনবিআরের শুল্ক বিভাগ আর রপ্তানি আয় থেকে বাদ দিয়ে হিসাব করে না।’ তিনি আরও বলেন, রপ্তানি আয় কম আসার অন্য কারণও থাকতে পারে। যেমন ডলারের দাম যেহেতু বাড়তি, সেহেতু কেউ হয়তো মনে করলেন রপ্তানি আয় কিছুদিন পরেই আসুক। তাতে বাড়তি দর পাওয়া যাবে।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক সম্প্রতি প্রথম আলোকে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির রপ্তানির পরিসংখ্যানের পার্থক্য ব্যাখ্যা করতে একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি কাজ করছে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়া গেলে অনেক কিছু পরিষ্কার হবে।
বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সাড়ে ৮৪ শতাংশই তৈরি পোশাক। এক বছর ধরে ধরেই পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তাদের কেউ প্রকাশ্যে, কেউবা ব্যক্তিগতভাবে ইপিবির প্রকাশিত তৈরি পোশাকের রপ্তানি পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছেন। তাঁদের যুক্তি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। ফলে ক্রেতারা প্রয়োজনীয় নয়, এমন পণ্য কেনা কমিয়ে দেন। তাতে কমে যায় পোশাকের বিক্রিও। গ্যাস-বিদ্যুতের কারণে দেশেও উৎপাদন কমবেশি ব্যাহত হয়েছে।
নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, প্রকৃতপক্ষে রপ্তানি যা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি দেখানো হচ্ছে। এতে রপ্তানিকারকদের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়বে। দ্রুত রপ্তানি আয়ের গরমিল ঠিক করা উচিত। গরমিল কোথায় হচ্ছে, সেটি খুঁজে বের করতে সরকারি দপ্তরের পাশাপাশি বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এবং অর্থনীতিবিদদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের মতো তথ্য-পরিসংখ্যানের অসংগতি ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে দেখা যায় না। তাদের তথ্য-পরিসংখ্যান অনেক বেশি স্বচ্ছ। তিনি বলেন, পণ্য রপ্তানি আয়ে ইপিবি, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে বড় ধরনের পার্থক্য থাকার অর্থ হচ্ছে, কিছু না কিছু সমস্যা আছে। সেই সমস্যাটি চিহ্নিত করা সম্ভব, যদি সমন্বিতভাবে পরিসংখ্যান করা হয়। তিন দপ্তর মিলে কেন সেটি করতে পারল না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। পরিসংখ্যানে গরমিল থাকলে নীতি নির্ধারণে সমস্যা হবে। রাষ্ট্রের লেনদেনের ভারসাম্যেও সমস্যা দেখা দেবে।