সন্দেহজনক লেনদেন বাড়িয়েছে ই–কমার্স
করোনার প্রকোপের মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) ও সন্দেহজনক কার্যক্রম সংঘটিত হয়েছে ৫ হাজার ২৮০টি। ঠিক আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৭৫। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এমন লেনদেন ও কার্যক্রম হয়েছিল ৩ হাজার ৫৭৩টি।
করোনার মধ্যে সন্দেহজনক লেনদেন বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে বিভিন্ন ই-কমার্স ও এমএলএম প্রতিষ্ঠানের প্রতারণামূলক কার্যক্রম। এ ছাড়া রিপোর্টিং প্রতিষ্ঠানগুলো আগের চেয়ে সতর্ক হওয়ায় সন্দেহজনক লেনদেনের ওপর প্রতিবেদন বাড়ছে।
সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) বেড়ে যাওয়া মানেই অবৈধ অর্থ লেনদেন বা অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়া নয়। সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এমনটা হচ্ছে। সামনে এসটিআর আরও বাড়বে।মাসুদ বিশ্বাস, প্রধান, বিএফআইইউ
অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধের কেন্দ্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএফআইইউর নতুন প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। এবারই প্রথমবারের মতো বিএফআইইউ আনুষ্ঠানিকভাবে এই তথ্য তুলে ধরল। প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাই বিএফআইইউ পরিচালনা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) বেড়ে যাওয়া মানেই অবৈধ অর্থ লেনদেন বা অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়া নয়। সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এমনটা হচ্ছে। সামনে এসটিআর আরও বাড়বে।
সংবাদ সম্মেলনে বেশির ভাগ গণমাধ্যমকর্মীর প্রশ্ন ছিল দেশে থেকে বিপুল অর্থ পাচার এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশিদের তারকা হোটেল, রিসোর্ট, বাড়ি কেনাসহ নানা বিষয়ে। এসব প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন বিএফআইইউর কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, আইনত এসব তথ্য প্রকাশের সুযোগ নেই।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের ডিসেম্বর ও ২০২১ সালের জুনে সন্দেহজনক লেনদেন ২৫০ ছাড়িয়ে যায়। অন্য মাসগুলোয় এমন রিপোর্ট আসে ১৫০-২৫০টি। পুরো অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৪৯৫টি সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্ট জমা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। আর এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো ৬৭০টি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ১০০টি রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এ ছাড়া গত বছর নগদ লেনদেন প্রতিবেদনের (সিটিআর) সংখ্যা বেড়েছে।
ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা, ব্রোকারেজ হাউসগুলো কোনো লেনদেনকে সন্দেহজনক মনে করলেই বিএফআইইউকে অবহিত করে। আর ১০ লাখ টাকার বেশি লেনদেন হলে সিটিআর রিপোর্ট করে।
গত অর্থবছরে বিএফআইইউ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ১ হাজার ৪১৪টি প্রতিবেদন আদান–প্রদান করে। এই সংখ্যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭৮৭টি ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৯১টি ছিল। এর মধ্যে গত অর্থবছরে বিএফআইইউ ১২টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় ও ৪৪টি শাখায় বিশেষ পরিদর্শন করে।
আর বিভিন্ন দেশের এফআইইউ গত অর্থবছরে ২২টি বিষয়ে বিএফআইইউর কাছে জানতে চেয়েছে, আর বিএফআইইউ বিভিন্ন দেশের কাছে ১৯১টি বিষয়ে তথ্য চেয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক এ বি এম জহুরুল হুদা, উপমহাব্যবস্থাপক কামাল হোসাইন, যুগ্ম পরিচালক ইকরামুল হাসান বক্তব্য দেন।
টাকা পাচার হয়
অনুষ্ঠানে একজন সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, একটি ব্যাংকে চেয়ারম্যান সিঙ্গাপুরে বড় ব্যবসা গড়ে তুলেছেন, কানাডায় অনেকে বাড়ি কিনেছেন, পানামা পেপারস ও প্যান্ডোরা পেপারসে অনেকের নাম এসেছে। এ ছাড়া পি কে হালদারও বড় আলোচিত বিষয়। তাঁদের নিয়ে আপনারা কী করছেন?
আরেকজন প্রশ্ন করেন, দেশ থেকে টাকা পাচার হওয়া সহজ হয়ে গেছে। তবে ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটও সহজ হয়ে গেছে। পদ্ধতিগত সমস্যার কারণে এমনটা হচ্ছে কি না?
এসব প্রশ্নের জবাবে বিএফআইইউর উপমহাব্যবস্থাপক কামাল হোসাইন বলেন, ‘পি কে হালদারের কাজ করতে গিয়ে কয়েক মাস সময় লেগেছে। আর যেসব বিদেশি প্রতিষ্ঠান টাকা পাচারের তথ্য প্রকাশ করে, আমরা তা আমলে নিই না। তবে আমরাও মনে করি, টাকা পাচার হয়। বিভিন্ন প্রতিবেদনেও তা এসেছে।’
দেশ থেকে টাকা পাচার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। এ নিয়ে কাজ হচ্ছে। আর ভবিষ্যতে বিএফআইইউকে শক্ত অবস্থানে দেখা যাবে।মাসুদ বিশ্বাস, প্রধান, বিএফআইইউ
বিএফআইইউর নতুন প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, দেশ থেকে টাকা পাচার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। এ নিয়ে কাজ হচ্ছে। আর ভবিষ্যতে বিএফআইইউকে শক্ত অবস্থানে দেখা যাবে।
বিএফআইইউ কি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, এর জবাবে কামাল হোসাইন বলেন, বিএফআইইউ যে কার্যক্রম চালায়, সে ক্ষেত্রে স্বাধীন। তবে বিএফআইইউ প্রধান গভর্নরকে রিপোর্ট করেন।
অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী বিএফআইইউ হলো অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধের কেন্দ্রীয় সংস্থা। বিএফআইইউ বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে পরিদর্শন করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাঠায়।