সুদহার বৃদ্ধি
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দিশেহারা বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক
■ এখনকার মূল্যস্ফীতি সরবরাহ সংকটজনিত। ফলে মুদ্রানীতির রাশ টেনে তেমন একটা লাভ হবে না বলেই অনেকে মনে করেন।
■ পশ্চিমা দেশগুলোতে ২০১০-এর দশকে নগদ সরবরাহ অনেক বেড়ে গেলেও মূল্যস্ফীতির হার ঐতিহাসিকভাবে কম ছিল।
বিশ্ব অর্থনীতির এখন মাথাব্যথার সবচেয়ে বড় কারণ মূল্যস্ফীতি। অধিকাংশ দেশে মহামারিজনিত বিধিনিষেধ শেষ হওয়ার পর এখন চাহিদা তুঙ্গে। কেনাকাটা যেন বাঁধ ভেঙেছে। মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে সবচেয়ে অব্যর্থ অস্ত্র হচ্ছে সুদহার বৃদ্ধি করে চাহিদায় লাগাম পরানো।
কিন্তু এখন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সময়। সে জন্য এত দিন বিশ্বের কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই পথে না হাঁটলেও ব্যাংক অব ইংল্যান্ড শেষমেশ নিষ্ক্রিয় নীতি থেকে সরে এল। গত বৃহস্পতিবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে তারা। রাশিয়া ইতিমধ্যে সুদহার ১ শতাংশ বাড়িয়েছে। আগামী বছর মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভও একই পথ অনুসরণ করবে। ২০২২ সালে তারা তিনবার নীতি সুদহার বৃদ্ধি করবে বলে পূর্বাভাসে জানা গেছে।
তবে উল্টো ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। নভেম্বর মাসে তুরস্কে মূল্যস্ফীতির হার ২১ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়ালেও দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুদহার কমাতে চাপ দিয়েই যাচ্ছেন। গত মাসে টানা চতুর্থবার সুদহার কমানো হয়েছে। এই অবস্থায় অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, আগামী বছর মূল্যস্ফীতির হার ৩০ শতাংশে উঠতে পারে।
তবে এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় খুব দীর্ঘ হবে না বলেই মনে করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। মূল্যস্ফীতি নিয়ে গবেষণায় তারা দেখেছে, ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে পারে। উন্নত দেশের মূল্যস্ফীতি ইতিমধ্যে চূড়া পেরিয়ে গেছে। ২০২২ সালের জুন মাস নাগাদ তা কমতে শুরু করবে। উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রেও প্রায় একই পূর্বাভাস করা হয়েছে। শীতের আগে ৬ দশমিক ৮ শতাংশে উঠেছিল এই হার। এরপর তা ৪ শতাংশে নেমে আসবে।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া টানা ৯ প্রান্তিকে সুদহার অপরিবর্তিত রেখেছে। যা–ই হোক না কেন, প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া দিতে তারা সুদহার বাড়ায়নি। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের খুচরা মূল্যবৃদ্ধির হার রিজার্ভ ব্যাংকের সহনশীলতার ঊর্ধ্বসীমার কাছাকাছি পৌঁছেছে। আর পাইকারি মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে। ফলে বিভিন্ন মূল্যায়ন ও পরামর্শক সংস্থা মনে করছে, জিডিপির কিছুটা প্রবৃদ্ধির পরে মূল্যস্ফীতিতে লাগাম পরানোর ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না আরবিআইয়ের সামনে। ব্রোকারেজ সংস্থা ব্যাংক অব আমেরিকা সিকিউরিটিজ ইন্ডিয়ার (বিওএফএ) পূর্বাভাস, ২০২২-২৩ অর্থবছরে একাধিকবার সুদহার বাড়ানো হতে পারে। তা মোট বাড়তে পারে ১০০ বেসিস পয়েন্ট। আর সে ক্ষেত্রে চাহিদার গতি কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
তবে এর সঙ্গে বেশ কিছু ঝুঁকির দিকও আছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে এবং ঋণনীতিতে ভারসাম্য আনতে সারা বছরে প্রায় ১০০ বেসিস পয়েন্ট সুদ বাড়াতে হতে পারে রিজ়ার্ভ ব্যাংককে। এখন সামগ্রিক ব্যাংকঋণ প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ এবং খুচরা ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ১২ শতাংশের কাছাকাছি। সুদের হার বাড়লে ধাক্কা খেতে পারে ঋণ এবং বাজারের সার্বিক চাহিদা। সে ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার পূর্বাভাসের চেয়ে কিছুটা কমার আশঙ্কাও আছে।
এদিকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে জ্বালানির দাম বেড়েছে। জাহাজ–সংকটের কারণে সৃষ্টি হয়েছে পরিবহন জটিলতা। এসব কারণেই মূলত সব পণ্যের দাম বাড়ছে। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বে অভিবাসনের হার কমে যাওয়ায় ঠিকা শ্রমিকের সংকট হয়েছে। আবার স্বাস্থ্যগত কারণে অনেকেই কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। শ্রমিকের সংকট থাকলে অবধারিতভাবে মজুরি বেড়ে যাবে।
আবার অনেক অর্থনীতিবিদ বলেন, মজুরি বৃদ্ধি বা শিথিল মুদ্রানীতির কারণেও মূল্যস্ফীতি বাড়ে না। গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বার্ষিক হিসাবে সাপ্তাহিক মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ এই সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল গড়ে ২ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের একাংশ বলেন, মজুরি বাড়লে মুনাফার হার কমে। সে জন্য মূলধারার অর্থনীতিবিদেরা সব সময় মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে শোরগোল করেন।
তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক উভয়সংকটে পড়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই মূল্যস্ফীতি সাময়িক হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগ্রাসী নীতি গ্রহণের প্রয়োজন নেই। কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদি হলে বিপদ হতে পারে। এতে বিনিয়োগের সম্ভাবনাও কমে যাবে। আবার মুদ্রানীতিতে রাশ টানা হলে বিনিয়োগে ভাটা পড়ে। পশ্চিমা দেশগুলোতে ২০১০-এর দশকে নগদ সরবরাহ অনেক বেড়ে গেলেও মূল্যস্ফীতির হার ঐতিহাসিকভাবে কম ছিল।
এখনকার মূল্যস্ফীতি সরবরাহ সংকটজনিত। ফলে মুদ্রানীতির রাশ টেনে তেমন একটা লাভ হবে না বলেই অনেকে মনে করেন। এই পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিষয়টি নির্ভর করছে সরবরাহব্যবস্থা ও রাজনীতি অর্থনীতির ওপর। কোভিডের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়েছে। এখন সেই ক্ষতি কীভাবে কাটানো হবে, সেটাই মূল ব্যাপার। আর মহামারি নিয়ন্ত্রণের বিষয় তো আছেই। সূত্র: বিবিসি, সিএনএন