বন্ডে প্রবাসীদের বিনিয়োগ কমেছে
দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশি, অর্থাৎ প্রবাসীরা সরকারের তিনটি বন্ড কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে তাঁরা আগের চেয়ে বন্ডের অর্থ বেশি ভাঙছেন। সরকার বন্ডে বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দেওয়ায়, নবায়নের সুবিধা উঠে যাওয়ায় এবং করোনাভাইরাসের ধাক্কায় বন্ডে প্রবাসীদের বিনিয়োগে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনাভাইরাসের আগে এসব বন্ডে বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রবণতা ছিল। তখন বিনিয়োগেও কোনো সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত ছিল না। কিন্তু সরকার ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর তিনটি বন্ডে প্রবাসীদের জনপ্রতি বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা ১ কোটি টাকায় বেঁধে দেয়। আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিনিয়োগ নবায়নের সুবিধাও বন্ধ করা হয়। এর ওপর প্রবাসীদের আয়েও করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে। এই তিন কারণে তিনটি বন্ডে প্রবাসীদের বিনিয়োগ কমেছে। অন্যদিকে হাতে থাকা বন্ডগুলো ভাঙাচ্ছেন।
অনেকে দেশ থেকে অবৈধ পথে বিদেশে অর্থ নিয়ে এসব বন্ডে বিনিয়োগ করেন। তাই সরকার বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দিয়েছে। তা ছাড়া করোনার কারণে প্রবাসীদের আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাই বন্ডে বিনিয়োগ কমছে। প্রবাসীদের আয় বাড়লে আবার বিনিয়োগ বাড়বে। কারণ, এত মুনাফা অন্য কোথাও বিনিয়োগ করে পাওয়া যায় না।মোহাম্মদ সমিউল্লাহ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, সিঙ্গাপুরের প্রাইম এক্সচেঞ্জ
প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের চালু করা উচ্চ সুদের বন্ডগুলো হচ্ছে—ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড।
জানা গেছে, ২০১৯ সালে এসব বন্ডে প্রবাসীদের বিনিয়োগের স্থিতি ছিল ১২ হাজার ৬৫৮ কোটি, যা ২০২০ সালের জুনে ১৩ হাজার ৯০৩ কোটি, ২০২১ সালের জুনে ১৪ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা হয়। কিন্তু সীমা নির্ধারণের পরে চলতি বছরের জানুয়ারিতে স্থিতি কমে ১৪ হাজার ২৮৯ কোটি টাকায় নেমে আসে।
বিষয়টি নিয়ে সিঙ্গাপুরের প্রাইম এক্সচেঞ্জের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সমিউল্লাহ বলেন, অনেকে দেশ থেকে অবৈধ পথে বিদেশে অর্থ নিয়ে এসব বন্ডে বিনিয়োগ করেন। তাই সরকার বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দিয়েছে। তা ছাড়া করোনার কারণে প্রবাসীদের আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাই বন্ডে বিনিয়োগ কমছে। প্রবাসীদের আয় বাড়লে আবার বিনিয়োগ বাড়বে। কারণ, এত মুনাফা অন্য কোথাও বিনিয়োগ করে পাওয়া যায় না।
২০২১ সালে প্রবাসী আয় সামান্য বেড়ে ২ হাজার ২০৭ কোটি ডলার হয়, যা ২০২০ সালে ছিল ২ হাজার ১৭৪ কোটি ডলার। তবে বছরভিত্তিক হিসাবে আয় বাড়লেও অর্থবছর হিসাবে আয় কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ।
দেশে ১৯৮৮ সালে ৫ বছর মেয়াদি ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড এবং ২০০২ সালে ৩ বছর মেয়াদি ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড চালু হয়।
ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সমমূল্যের ডলারের বিনিয়োগের ওপর মুনাফা ১২ শতাংশ। আর ১৫ লাখ ১ টাকা থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ১১ শতাংশ, ৩০ লাখ ১ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ১০ শতাংশ এবং ৫০ লাখ ১ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ৯ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই বন্ড বিক্রি হয় ১ হাজার ৯০২ কোটি টাকার, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৬৬ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৪১ কোটি ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা হয়। চলতি ২০২১–২২ অর্থবছরের জুলাই–জানুয়ারি সাত মাসে বিক্রি হয়েছে ৫৫৮ কোটি টাকার। এ সময় বন্ড ভাঙানো হয় ৫২৫ কোটি টাকার।
ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডে মেয়াদ শেষে মুনাফা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রথম বছর শেষে কেউ মুনাফা তুলতে চাইলে পাবেন ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। দ্বিতীয় বছর শেষে মুনাফা মিলবে ৭ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই বন্ডে প্রবাসীরা বিনিয়োগ করেছিলেন ১৫ কোটি টাকা। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৩ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৭ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০ কোটি টাকা ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন তাঁরা। চলতি ২০২১–২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই–জানুয়ারি) বিনিয়োগ হয় মাত্র ৪ কোটি টাকা। আর এ সময় ৫৩ কোটি টাকার বন্ড নগদায়ন বা ভাঙানো হয়েছে।
ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের সুদের হারও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই বন্ড বিক্রি হয়েছিল ২৪৩ কোটি টাকার। এরপর ২০১৭–১৮ অর্থবছরে ৩৪৪ কোটি টাকার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৭১ কোটি টাকার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৪৯ কোটি টাকার ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৮০ কোটি টাকার বন্ড বিক্রি হয়। আর চলতি ২০২১–২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই–জানুয়ারি) বিক্রি হয়েছে মাত্র ২৮ কোটি টাকার। একই সময়ে প্রবাসীরা ৬০৩ কোটি টাকার ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড নগদায়ন করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক, এক্সচেঞ্জ হাউস ও এক্সচেঞ্জ কোম্পানি এবং তফসিলি ব্যাংকের বিদেশি ও অনুমোদিত ডিলার (এডি) শাখায় গিয়ে এসব বন্ড কেনা যায়। এসব বন্ডের মুনাফা আয়করমুক্ত। আবার বন্ডের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার সুযোগও আছে। এ ছাড়া বন্ড কিনতে ফরেন কারেন্সি বা বৈদেশিক মুদ্রায় (এফসি) হিসাব থাকারও বাধ্যবাধকতা নেই।
আগে প্রবাসীরা ইচ্ছেমতো এই বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারতেন। এখন সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি করোনার কারণেও প্রবাসীরা আগের মতো বিনিয়োগ করতে পারছেন না।এম এস সেকিল চৌধুরী, চেয়ারপারসন, এনআরবি
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, আগে মেয়াদ শেষ হলে বন্ডগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নবায়ন হতো। এখন নবায়নের জন্য গ্রাহকদের ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউসে যেতে হয়। তাই নবায়নের হার কমে গেছে। অন্যদিকে নগদায়ন বা বন্ড ভাঙানোর প্রবণতা বেড়ে গেছে। আবার যাঁদের বেশি বিনিয়োগ ছিল, তাঁরাও বিনিয়োগ কমিয়ে ফেলছেন। এসব বন্ডে বিনিয়োগের বড় অংশই প্রবাসী ব্যবসায়ীদের। প্রবাসী শ্রমিকদের বিনিয়োগ কম।
বন্ডে বিনিয়োগ কমে যাওয়া নিয়ে সেন্টার ফর এনআরবির চেয়ারপারসন এম এস সেকিল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আগে প্রবাসীরা ইচ্ছেমতো এই বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারতেন। এখন সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি করোনার কারণেও প্রবাসীরা আগের মতো বিনিয়োগ করতে পারছেন না।