কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা
ন্যাশনাল ব্যাংক ঋণ দিতে পারবে না
ব্যাংকটিকে ঋণ দিতে হলে আমানতে বড় প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। পাশাপাশি ঋণ আদায় আগের চেয়ে বাড়াতে হবে।
বেনামি ঋণ ঠেকাতে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংকটিতে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিয়োগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকটি এখনই আর কোনো ঋণ দিতে পারবে না। আর চাইলেও ইচ্ছেমতো যে কাউকে নিয়োগ দিয়ে ব্যাংক পরিচালনা করতে পারবে না। এ ছাড়া শীর্ষ গ্রাহকদের ঋণ আদায়ে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত সোমবার ন্যাশনাল ব্যাংককে এই নির্দেশনা দিয়েছে।
এর মাধ্যমে বেসরকারি খাতের এই ব্যাংককে নিয়মে ফেরাতে চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ন্যাশনাল ব্যাংকের বিষয়ে অতীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এমন সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। এর আগে শেষ চেষ্টা হিসেবে শেষ মুহূর্তে বেসিক ব্যাংক ও সাবেক ফারমার্স (এখন পদ্মা) ব্যাংকের ক্ষেত্রে একই উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাংক দুটিকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। এখন ন্যাশনাল ব্যাংকের বিষয়ে একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ সৈয়দ আবদুল বারী। তবে তিনি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নির্দেশনায় কী বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ন্যাশনাল ব্যাংকে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত ৮৭ শতাংশে না আসা পর্যন্ত কোনো ঋণ বিতরণ করতে পারবে না। বর্তমানে ব্যাংকটির ঋণ-আমানত অনুপাত ৯২ শতাংশ। ব্যাংকটির আমানত প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা ও ঋণ ৪১ হাজার কোটি টাকা। ফলে ব্যাংকটিকে ঋণ দিতে হলে আমানতে বড় প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। পাশাপাশি ঋণ আদায় আগের চেয়ে বাড়াতে হবে। যদিও সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে আমানত সংগ্রহে বড় ধাক্কা খেয়েছে ব্যাংকটি। চিঠি অনুযায়ী, ব্যাংকটি যদি ঋণ-আমানত অনুপাত ৮৭ শতাংশে নামিয়ে এনে ঋণ দিতে চায়, তাহলেও ঋণে ১০ শতাংশের বেশি বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হতে পারবে না।
আর ব্যাংকটির জন্য বড় অঙ্কের ঋণ ও একক গ্রাহক ঋণসীমা নতুন করে নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা, এর ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ১৫৩ কোটি টাকা হবে বড় ঋণের সীমা। অন্যদিকে একক গ্রাহক ঋণসীমা হবে পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশ বা ৩০৬ কোটি টাকা। এই সীমা নগদ ঋণ (ফান্ডেড) ও ঋণ সুবিধা (নন-ফান্ডেড) ঋণসহ। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ব্যাংকটি অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ঋণ অধিগ্রহণ বা কিনতে পারবে না।
পাশাপাশি শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতার ঋণ আদায়ের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিতে বলা হয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলো শীর্ষ খেলাপিদের থেকে ঋণ আদায়ের তথ্য জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ন্যাশনাল ব্যাংকের ক্ষেত্রে শীর্ষ গ্রাহকদের তথ্য দিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকটির গত ফেব্রুয়ারিভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, ব্যাংকটির শীর্ষ ২০ গ্রাহকের মধ্যে অন্যতম হলো এস আলম গ্রুপ, মায়শা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, সাদ মুসা, নাফ ট্রেডিং, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, এফএমসি ডকইয়ার্ড, প্রাণ-আরএফএল, ব্লুম সাকসেস ইন্টারন্যাশনাল, ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠিতে আরও বলেছে, ব্যাংকটিতে উপদেষ্টা, পরামর্শক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিম্নতর দুই পদে নিয়োগ দিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে। এর ফলে ব্যাংকটিতে শীর্ষ পর্যায়ে পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সিকদার পরিবারের ছেলেদের পক্ষে ব্যাংকটি এত দিন পরিচালনা করতেন সাবেক অতিরিক্ত এমডি এ এস এম বুলবুল। তাঁকে এমডি পদে দায়িত্ব পালনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় আপাতত তিনি ব্যাংকে আসছেন না। ফলে তাঁকে নতুন করে নিয়োগ দিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে।
কেন এমন সিদ্ধান্ত
ন্যাশনাল ব্যাংকের দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার গত ১০ ফেব্রুয়ারি মারা যান। ২৪ ফেব্রুয়ারি নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। এরপর কোনো পর্ষদ সভা না হলেও প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়, যার সুবিধাভোগী নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে। চেয়ারম্যানের মৃত্যুর পর মূলত তাঁর ছেলেরা ব্যাংকটি পরিচালনা করছেন। বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন ব্যাংকটির কিছু শীর্ষ কর্মকর্তাও। এ নিয়ে সিকদার পরিবার ও ব্যাংকটির পরিচালকদের মধ্যে বিভক্তি প্রকট হয় গত ১২ ফেব্রুয়ারির পরিচালনা পর্ষদে। সেদিন নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে বিতরণ করা ঋণের অনুমোদনের প্রস্তাব উঠলে তাঁর মেয়ে ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান পারভীন হক সিকদার বিরোধিতা করেন। তাঁকে সমর্থন দেন সিকদার পরিবারের বাইরের পরিচালকেরাও। ফলে এসব ঋণ আর অনুমোদিত হয়নি।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার, পরিচালকদের মধ্যে দুই ছেলে রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদার এবং সিকদার গ্রুপের কর্মকর্তা নাইমুজ্জামান ভূঁইয়া ও বদিউল আলম এক পক্ষে আছেন। আর বিপরীতে অবস্থানে থাকা পারভীন হক সিকদারকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিচ্ছেন কেডিএস গ্রুপের খলিলুর রহমান, হোসাফ গ্রুপের মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাবরুর হোসেন এবং জাকারিয়া তাহের। তাঁরা চাইছেন ব্যাংকটিতে নতুন করে আর অনিয়ম না হোক। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিশেষ পরিদর্শন অব্যাহত রেখেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ন্যাশনাল ব্যাংকে দীর্ঘদিন এমডি নেই। এখন শুধু তিন মাসের জন্য এমডি নিয়োগ দিয়েছে। ব্যাংকের কিছু পরিচালক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন। এই কারণে ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞাসহ বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে নিশ্চয়ই এসব তুলে নেওয়া হবে। তবে আগে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হবে।
আলোচনায় পরিচালক দুই ছেলে
২০০৯ সালে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদেরও বদল হয় ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের (এনবিএল)। ব্যাংকটির কর্তৃত্ব তখনই চলে যায় সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের কাছে। এরপর অন্য সব পরিচালককে কৌশলে বের করে দেওয়া হয়। নিজের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন ও আওয়ামী লীগ নেতাদের পর্ষদে যুক্ত করে ব্যাংকটির একক নিয়ন্ত্রণ নেয় সিকদার পরিবার। এরপর থেকেই প্রথম প্রজন্মের এ ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করে। ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৩৮৮ কোটি টাকা, গত ডিসেম্বরে যা বেড়ে হয় ২ হাজার ৮৫ কোটি টাকা।
বেসরকারি খাতের ব্যাংকের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকই সবচেয়ে বেশি অবলোপন করে আর্থিক স্থিতিপত্র থেকে খেলাপি ঋণ বাদ দিয়েছে। তারপরও কমাতে পারেনি খেলাপি ঋণ। অবলোপন করা এ ঋণ গত বছর ছিল ২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদনে এসেছে, গ্রাহকের ঋণের টাকা সরাসরি জমা হয়েছে সিকদার গ্রুপ ও তাদের ছেলেদের হিসাবে। ফলে ব্যাংকটির প্রকৃত চিত্র এখনো অজানা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। এতে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে।সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
এর মধ্যেই এক্সিম ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া ও অতিরিক্ত এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে গত বছরের ৭ মে গুলি করে আলোচনায় আসেন সিকদার গ্রুপের এমডি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক রন হক সিকদার এবং তাঁর ভাই দিপু হক সিকদার। ১৯ মে এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মামলা করলে ২৫ মে দুপুরে দুই ভাই রোগী হিসেবে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা ছেড়ে যান। পালিয়ে থাকা অবস্থায় জামিনের আবেদন করলে আদালত জরিমানাও করেছিলেন। জয়নুল হক সিকদারের মৃত্যুর পর গত ১২ ফেব্রুয়ারি রন হক সিকদার দেশে এলে আটকের পর জামিন পান। আরেক ভাই দিপু হক সিকদার এখনো পলাতক। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চাপের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগে চুপ ছিল। এখন হয়তো চাপ নেই, এ জন্য সক্রিয়। এ ছাড়া বড় ব্যাংক হওয়ায় ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রভাব অন্য ব্যাংকে গিয়ে পড়বে। আমানতকারীদের মধ্যে অনাস্থা দেখা যাবে। এ চিন্তা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। এটা ভালো হয়েছে। এতে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে। ব্যাংকটিকে এখন ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে। তাহলেই ঋণ বিতরণ করতে পারবে। বেছে বেছে শুধু ভালো গ্রাহকদের ঋণ দিতে হবে।