করোনাভাইরাসের যে প্রকোপ সারা বিশ্বে চলছে, তাতে কবে স্বাভাবিক জীবন ফিরবে, তা অনিশ্চিত। করোনা দূর না হওয়া পর্যন্ত নতুন স্বাভাবিক বা নিও নরমাল জীবন চালাতে হবে। এ জন্য আর্থিক লেনদেন যতটা ঘরে বসে করা সম্ভব, ততই মঙ্গল। বর্তমানে বাংলাদেশের মোবাইলে আর্থিক সেবার (এমএফএস) যতটা প্রসার ঘটেছে, তা দিয়েই অনায়াসেই ছোট আকারের বিভিন্ন লেনদেন করা যাচ্ছে। বিকাশ, রকেট, নগদ, শিওরক্যাশ, ইউক্যাশ, এমক্যাশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মোবাইলে আর্থিক সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ এমএফএস চালু হয়েছিল মূলত ব্যাংক সেবাবঞ্চিত মানুষকে আর্থিক সেবায় আনার জন্য। তবে সময়ের ব্যবধানে এই সেবা এখন শহুরেদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পড়ছে। যদিও প্রান্তিক মানুষেরাই সবার আগে গ্রাহক হয়েছেন। এ জন্য তাঁরা খুব সহজেই বলতে পারেন বিকাশ, রকেট, নগদ দিয়ে কী করা যায়। তবে করোনাভাইরাস শহুরে মানুষকে এর প্রয়োজনীয়তা ঠিকই বুঝিয়েছে।
কারণ, এসব সেবা দিয়ে এখন সহজেই গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, টেলিফোন, ইন্টারনেট বিল, স্কুল-কলেজের বেতন পরিশোধ করা যাচ্ছে। আবার বাস, ট্রেন, লঞ্চ, বিমান ও সিনেমা দেখার টিকিটও পাওয়া যাচ্ছে। অনলাইন ও অফলাইনে কেনাকাটা করা যাচ্ছে, আবার মোবাইল রিচার্জ সুবিধাও আছে। এ ছাড়া অন্যের হিসাবে টাকা পাঠানো, অর্থ উত্তোলনসুবিধা তো রয়েছে। আর এখন এসব হিসাবে টাকা আনতে এজেন্টের কাছেও যেতে হচ্ছে না। সহজেই ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা আনা যাচ্ছে। এর সবই আপনি ঘরে বসে করতে পারছেন। এ জন্য কোথাও যেতে
হচ্ছে না।
আজ আমরা তুলে ধরব কীভাবে এই হিসাব খুলবেন। এখন আর হিসাব খোলার জন্য কোথাও যেতে হচ্ছে না। ঘরে বসে মোবাইল দিয়ে সহজেই হিসাব খোলা যাচ্ছে। আপনি যেই সেবায় হিসাব খুলতে চান, শুরুতে প্লে স্টার থেকে সেই অ্যাপস নামিয়ে চালু করুন।
ধরুন, আপনি ডাক বিভাগের সেবা নগদে হিসাব খুলতে চান। এ জন্য নগদ অ্যাপসে গিয়ে মুঠোফোন নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন শুরু করতে হবে। এরপর জাতীয় পরিচয়পত্রের দুই পাশের ছবি তুলে জমা দিতে হবে। এরপরই নিজের একটি ছবি তুলতে হবে। সঙ্গে আপনি পুরুষ না নারী, হিসাব ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক—এসব তথ্য নির্বাচন করে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হবে। তবে এখানেই শেষ নয়, নিরাপত্তার জন্য পাসওয়ার্ড নতুন করে নির্বাচন করতে হবে। যাতে আপনার হিসাব সহজেই কেউ হ্যাক করতে না পারে। এভাবেই আপনি সহজেই মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলতে পারেন।
ঘরে বসে হিসাব খোলার সুযোগ তৈরি হওয়ায় নারীদের হিসাব খোলা অনেক বেড়ে গেছে বলে সম্প্রতি এক ওয়েবিনারে জানিয়েছেন বিকাশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল কাদির। কারণ, অনেক নারী এজেন্টের কাছে গিয়ে পরিচয়পত্র ও ছবি দিয়ে হিসাব খুলতে বিব্রত হতেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত আগস্ট শেষে এমএফএসের গ্রাহক ৯ কোটি ২৯ লাখে উঠেছে, আর এজেন্ট ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। আগস্টে লেনদেন হয়েছে ৪১ হাজার কোটি টাকা। আগস্টে এমএফএসের মাধ্যমে ১০৪ কোটি টাকা প্রবাসী আয় বিতরণ করা হয়েছে, বেতন-ভাতা পরিশোধ হয়েছে ১ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। কেনাকাটা হয়েছে ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা। গ্যাস-বিদ্যুতের মতো পরিষেবা বিল পরিশোধ হয়েছে ৯০৮ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে করোনাভাইরাসের কারণে এমএফএস প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের নির্ভরতা অনেক বেড়ে গেছে। কারণ, ঘরে বসেই এসব সেবার হিসাব খোলা যাচ্ছে। টাকাও আনা যাচ্ছে ব্যাংক হিসাব থেকে। তাই হিসাব না থাকলে খুলে ফেলার সময় এখনই।
নগদের প্রায় সাড়ে তিন কোটি গ্রাহক। এর মধ্যে ৯২ শতাংশই ঘরে বসে হিসাব খুলেছেন। কারণ, গ্রামীণফোন, রবি ও টেলিটকের গ্রাহকেরা চাইলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রাহক হতে পারছেন। নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাহক হওয়া নিয়ে আর কাউকে চিন্তা করতে হচ্ছে না। এতে সহজেই আর্থিক সেবায় আসতে পারছেন মোবাইল ব্যবহারকারীরা।
এদিকে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কাল মঙ্গলবার থেকে আন্তলেনদেন সুবিধা চালু হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংক ও এমএফএসের মধ্যেও আন্তলেনদেন–ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। এ দুটি সেবা চালু হলে গ্রাহকেরা সহজেই ব্যাংক থেকে এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে এবং এমএফএস প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাংকে টাকা স্থানান্তর করতে পারবেন।
জানা গেছে, শুরুতে এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই আন্তলেনদেন সেবায় যুক্ত হবে। বিকাশ, ইসলামী ব্যাংকের এমক্যাশ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ইউক্যাশ ও আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ইসলামিক ওয়ালেট থেকে গ্রাহকেরা একে অপরের মধ্যে লেনদেন করতে পারবেন। অর্থাৎ কোনো গ্রাহক চাইলে তাঁর বিকাশ হিসাব থেকে সহজেই এমক্যাশে টাকা পাঠাতে পারবেন। বর্তমানে একটি এমএফএস থেকে অন্য এমএফএসে টাকা স্থানান্তরের কোনো সুযোগ নেই।
আপাতত চারটি ব্যাংক ও চারটি এমএফএস প্রতিষ্ঠান এই সেবায় যুক্ত হলেও অন্যদের ৩১ মার্চের মধ্যে আন্তলেনদেন–ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটাও বলছে, এই সেবার জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে কোনো মাশুল নেওয়া যাবে না।
এমএফএসের নিজেদের মধ্যে লেনদেনের পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ও পূবালী ব্যাংক থেকে এমএফএস প্রতিষ্ঠানে টাকা লেনদেন করা যাবে। অর্থাৎ এ চার ব্যাংকের কোনো গ্রাহক চাইলে তাঁদের ব্যাংক হিসাব থেকে আপাতত বিকাশসহ চারটি এমএফএস প্রতিষ্ঠানের হিসাবে টাকা পাঠাতে পারবেন। একইভাবে এমএফএস হিসাব থেকে ওই চার ব্যাংকের হিসাবে টাকা পাঠানো যাবে।
আপাতত চারটি ব্যাংক ও চারটি এমএফএস প্রতিষ্ঠান এই সেবায় যুক্ত হলেও অন্যদের ৩১ মার্চের মধ্যে আন্তলেনদেন–ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটাও বলছে, এই সেবার জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে কোনো মাশুল নেওয়া যাবে না। তবে ব্যাংক ও এমএফএসগুলো কীভাবে মাশুল ভাগাভাগি করবে, সেটি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।