দেশের ৬০ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, ব্যাংক খাতের অবস্থা স্বাভাবিকের চেয়ে খারাপ। ২০১৯ সালের তুলনায় দেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। বৈশ্বিক প্রতিযোগী সক্ষমতা জরিপে অংশ নিয়ে এ দেশের ব্যবসায়ীরা এ মন্তব্য করেছেন। পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন প্রশাসনিক অদক্ষতাকে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ২০২০ সালের বৈশ্বিক প্রতিযোগী সক্ষমতা প্রতিবেদন (জিসিআর) ও বাংলাদেশ ব্যবসায় পরিবেশ সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) পক্ষে বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি (সিপিডি) জিসিআর প্রকাশ করেছে। ব্যবসায় পরিবেশ সমীক্ষা প্রতিবেদনটি সিপিডির নিজস্ব। এ দুটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ব্যবসা–বাণিজ্য নিয়ে ব্যবসায়ীদের মতামত উঠে এসেছে।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, বগুড়া ও কুমিল্লার ৫৫টি বেসরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর এ জরিপ চালায় সিপিডি। ১০ কোটি টাকার ওপর সম্পদ আছে, এমন প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীদের মতামত নেওয়া হয়েছে।
জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের ৭২ শতাংশ মনে করেন, অদক্ষ সরকারি প্রশাসনই ব্যবসা-বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে এক নম্বর সমস্যা। এর পরের দুটি সমস্যা হলো দুর্নীতি ও অর্থায়নের। ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে দ্বিতীয় বড় সমস্যা মনে করেন ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী। আর ৬৬ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, সীমিত অর্থায়নের ব্যবস্থাটিও আরেক সমস্যা।
ব্যবসায়ীদের নিয়ে করা দুটি জরিপের ফলাফল উপলক্ষে গতকাল সকালে অনলাইনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সিপিডি। সেখানে জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের কাছে একেক সময় একেকটি সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। একসময় দুর্নীতি ছিল বড় সমস্যা। পরে দুর্বল অবকাঠামো বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। এখন দুর্নীতিকে ছাপিয়ে অদক্ষ সরকারি প্রশাসনকে বড় সমস্যা মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
এবার করোনার কারণে অন্য বছরের মতো বৈশ্বিক প্রতিযোগী সক্ষমতা সূচকের র্যাঙ্কিং প্রকাশ করা হয়নি। গতবার প্রকাশিত সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪১টি দেশের মধ্যে ১০৫তম। র্যাঙ্কিং প্রকাশ করা না হলেও অন্যবারের মতো এবারও জরিপে ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল সংশ্লিষ্ট দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে।
জরিপে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্বল অবকাঠামো, উচ্চ কর হার, অদক্ষ শ্রমিক, দুর্বল শ্রমনীতি, বারবার সরকারের নীতি পরিবর্তন, জটিল করপদ্ধতি, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি।
গতকাল ২০২০ সালের বৈশ্বিক প্রতিযোগী সক্ষমতা প্রতিবেদন (জিসিআর) প্রকাশ করা হয়েছে
জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরা ২০১৯ সালে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে কী ধরনের সমস্যা পড়েছেন, তা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, অর্থায়নের
ক্ষেত্রে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই ঋণ পাচ্ছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অর্থায়নের সমস্যা প্রকট।
বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যকে আরও প্রতিযোগী সক্ষম করে তুলতে ১২টি বিষয়ের প্রতি জোর দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। যেসব বিষয়ে জোর দিতে বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সুশাসন, অবকাঠামো, প্রযুক্তি, মানবসম্পদ, অর্থায়নের পরিবেশ, বৈদেশিক বাণিজ্য, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, ব্যবসায় পরিচালনা, নিরাপত্তা, ঝুঁকি ইত্যাদি। বৈশ্বিক প্রতিযোগী সক্ষমতা প্রতিবেদনের ২৩টি সূচকের মধ্যে মাত্র দুটি সূচকে বাংলাদেশ ৫০–এর বেশি নম্বর বা স্কোর তুলতে পেরেছে। এই দুটি সূচক হলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং ‘গিগ’ অর্থনীতিতে কাজের সম্ভাবনা বৃদ্ধি। সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ করেছে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব এবং অনলাইনে ব্যক্তিগত সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে গিগ অর্থনীতির দুর্বলতা সূচকে। এই দুটি সূচকেই বাংলাদেশ ২৯ দশমিক ৬ পয়েন্ট পেয়েছে।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিযোগী সক্ষমতা সুদৃঢ় করতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে গিয়ে যেন কমর্সংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর দক্ষ সরকারি প্রশাসন তৈরি করতে হলে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
এবার কোনো র্যাঙ্কিং প্রকাশ করা হয়নি।
২৩টি সূচকের মধ্যে দুই সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৫০–এর বেশি।
৭২% ব্যবসায়ী মনে করেন, প্রশাসনিক অদক্ষতাই এ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান সমস্যা।
আর্থিক দুর্বলতা
জরিপে অংশ নেওয়া ৮৪ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, এ দেশে স্টার্টআপ ব্যবসার জন্য অর্থ পাওয়া কঠিন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য অর্থায়ন এখনো সহজলভ্য নয় বলে জানিয়েছেন ৬২ শতাংশ ব্যবসায়ী। সিপিডি বলছে, করোনা সংকট কাটিয়ে উঠতে ব্যাংকিং খাত বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য তা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যাংক খাতের প্রণোদনার টাকা বেশি পেয়েছে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, দক্ষ ও উন্নয়নমুখী অর্থনীতির জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য করার পরিবেশ সহজ করতে হবে। কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা ধরনের রূপান্তর প্রয়োজন। প্রযুক্তির উৎকর্ষ বাড়াতে হবে।
বিশ্ব পরিস্থিতি
করোনা প্রেক্ষাপটে এবারের বৈশ্বিক প্রতিযোগী সক্ষম প্রতিবেদন তৈরি করতে ১৪২টি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এর মধ্যে ১২৬টি দেশ তথ্য-উপাত্ত দিয়েছে।
জিসিআর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার মধ্যেও বেশ কিছু দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে করোনা মহামারি ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে এমন দেশের তালিকায় আছে নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, এস্তোনিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশে বাড়ি থেকে কাজ করেছেন বহু লোক। এ ছাড়া সুদৃঢ় সামাজিক নিরাপত্তা থাকায় কিছুটা কম সমস্যায় পড়েছে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, অস্ট্রিয়া, লুক্সেমবার্গ ও সুইজারল্যান্ড।