ঋণের তথ্য মুছতে চায় সোনালী ব্যাংক

সোনালী ব্যাংকের ৫০ বছর পূর্তি ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসিবে বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে
ছবি: সংগৃহীত

রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১৫ বছর আগের তুলনায় কমেছে। ২০০৭ সালে এই হার যেখানে ৪৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ ছিল, সেখানে বর্তমানে তা ১৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। শুধু তা-ই নয়, আমানতেও উন্নতি ঘটেছে। যেমন ১০-১২ বছর আগে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির সময়ে ব্যাংকটিতে আমানতের পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার কোটি টাকা, যা এখন প্রায় আড়াই গুণ, অর্থাৎ ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ৯ বছরে ব্যাংকটির সম্পদ ৭৫ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত সোনালী ব্যাংকের ৫০ বছরপূর্তি ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির তালিকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, সালেহউদ্দিন আহমেদ ও আতিউর রহমানের নাম থাকলেও প্রথম দুজন অনুপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বাংলাদেশের প্রথম অর্থসচিব মতিউল ইসলাম ও বর্তমান অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার। স্বাগত বক্তব্য দেন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আতাউর রহমান প্রধান।

সোনালী ব্যাংকের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন অনুষ্ঠান কেক কেটে উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো.আতাউর রহমান প্রধান উপস্থিত ছিলেন।গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে
ছবি: সংগৃহীত

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৪ মার্চ ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, দি ব্যাংক অব ভাওয়ালপুর এবং দি প্রিমিয়ার ব্যাংক একীভূত হয়ে সোনালী ব্যাংক নামে যাত্রা শুরু করে। আর ২০০৭ সালের ৩ জুন থেকে এটি লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে ব্যাংকটির মোট শাখা ১ হাজার ২২৯টি।

এমডি আতাউর রহমান প্রধান বলেন, অনেক ইতিবাচক সূচক থাকলেও সোনালী ব্যাংকের ব্যালান্স শিট তথা স্থিতিপত্র ভালো নয়। স্থিতিপত্র ভালো না থাকার নেতিবাচক প্রভাব আছে। এ রকম অবস্থায় আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিদেশি ব্যাংকগুলো খারাপভাবে মূল্যায়ন করে।

আন্তর্জাতিক হিসাব পদ্ধতির মান অনুযায়ী ব্যাংকের স্থিতিপত্র থেকে আদায়ের অযোগ্য ঋণের চিত্র মুছে ফেলা অন্যায়। তবু আতাউর রহমান প্রধান অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘অর্থ বিভাগে আমরা প্রস্তাব জমা দিয়েছি। আর কোনো নগদ টাকা চাই না। এক টাকাও দিতে হবে না। কিন্তু স্থিতিপত্র থেকে কিছু বিষয় মুছে ফেলতে হবে (ক্লিয়ার করতে হবে)। এর ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমরা স্বীকৃতি পাব।’

চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকীও স্থিতিপত্র নিয়ে ব্যাংকের এমডির পক্ষে অবস্থান নেন। জানান, দায়িত্ব পালনকালে তিনি অর্থমন্ত্রী বা সচিবের কাছ থেকে অন্যায্য কোনো ফোন পাননি।

সোনালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি ঋণের হার কমার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ সুবিধা দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল, নতুন ঋণ বৃদ্ধি ও আদায়। যেমন ২০০৭ সালে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা, যার ৪৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ ছিল খেলাপি। গত ২০২১ সালে ৬৯ হাজার কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ১৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ ছিল খেলাপি।

সত্যিকার অর্থে খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। আর ব্যাংকটিকে পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় আনতে হবে। কাজ খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। নতুন নতুন আর্থিক পণ্য চালুর পাশাপাশি ভালো গবেষণা বিভাগও থাকতে হবে। আর দরকার দক্ষ জনবল। ডিপ্লোমা করে বসে থাকলেই চলবে না।
আবদুর রউফ তালুকদার, অর্থসচিব

অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। আর ব্যাংকটিকে পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় আনতে হবে। কাজ খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। নতুন নতুন আর্থিক পণ্য চালুর পাশাপাশি ভালো গবেষণা বিভাগও থাকতে হবে। আর দরকার দক্ষ জনবল। ডিপ্লোমা করে বসে থাকলেই চলবে না।’

অর্থসচিব আরও বলেন, দেশের ব্যাংক খাতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে কোনো ব্যাংক ফেল করেনি বা করতে দেওয়া হয়নি, যা ইউরোপ-আমেরিকায় প্রতি সপ্তাহে একটি করে হচ্ছে।

অর্থমন্ত্রী ও গভর্নর যা বললেন

প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে প্রথমেই তিনি বিশ্বাস রেখেছেন ব্যাংক খাতের ওপর। সে বিশ্বাস ব্যাংক খাত রেখেছে এবং তিনি এতে ঠকেননি। অর্থাৎ গত তিন বছরে মূলধন ঘাটতি কাটাতে সরকারের তহবিল থেকে কোনো অর্থ দিতে হয়নি। তিনি সোনালী ব্যাংককে ‘আস্থার অপর নাম’ হিসেবে উল্লেখ করেন। জানান, জনগণের আস্থার পাশাপাশি তাঁর নিজেরও আস্থা রয়েছে এ ব্যাংকের প্রতি।

ব্যাংক খাতে সুদের হার প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, এই হার ছিল ১৮ থেকে ২০ শতাংশ, যা বিশ্বের কোথাও নেই। এত উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে পেরে উঠবেন না। এত বেশি সুদ ধরেই বা কী হবে, যদি তা আদায় করা না যায়? যদি খেলাপি হয়ে যায়?

আপনারা ভালো কাজ করছেন। তবে গ্রাহকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবেন না। দুর্ব্যবহার করার কোনো অধিকার নেই আপনাদের।
ফজলে কবির, গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

আগের সুদ বহাল থাকলে কোভিডের এই সময়ে একটি প্রতিষ্ঠানকেও খুঁজে পাওয়া যেত না বলে মন্তব্য করেন মুস্তফা কামাল। জানান, ব্যাংকগুলোর গড় ঋণের সুদহার ১২ দশমিক ৩ থেকে ৭ দশমিক ১ শতাংশে নিয়ে আসা হয়েছে।

এদিকে গ্রাহকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার না করতে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রতি পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ফজলে কবির। ব্যাংকারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা ভালো কাজ করছেন। তবে গ্রাহকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবেন না। দুর্ব্যবহার করার কোনো অধিকার নেই আপনাদের।’

সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, কতিপয়ের নয়, বহু মানুষের ব্যাংক হিসেবে হাজির থাকতে হবে সোনালী ব্যাংককে।