প্রণোদনা ঋণ
আটকে গেছে সুদ ভর্তুকি, চাপে পড়েছে ব্যাংক
গত বছরে ব্যাংকগুলো সুদ ভর্তুকির টাকা পেলেও চলতি বছরে অর্থ ছাড় করেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনায় চাপ পড়ছে।
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোর যে সুদ ভর্তুকি পাওয়ার কথা, সেটি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। গত বছরে ব্যাংকগুলো সুদ ভর্তুকির টাকা পেলেও চলতি বছরে কোনো অর্থ ছাড় করেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। কারণ, নতুন করে সুদ ভর্তুকির টাকা ছাড় করার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিতরণ হওয়া প্রণোদনা ঋণের ব্যবহার যাচাই করতে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী ব্যাংকগুলোতে এখন পরিদর্শন কার্যক্রম চলছে।
এদিকে ব্যাংকাররা বলছেন, সুদ ভর্তুকি সময়মতো না পাওয়ায় ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনায় বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। যদিও এখনো গ্রাহকদের ওপর কোনো চাপ পড়েনি। তবে যাচাইয়ে অনিয়ম ধরা পড়লে ব্যাংকগুলোকে সুদ ভর্তুকির অর্থ ফেরত দিতে হবে।
বিভিন্ন ব্যাংক জানায়, বড় শিল্প ও সেবা খাতে ঋণ দেওয়ার জন্য তারা গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সুদ ভর্তুকি পেয়েছে। আর কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (সিএমএসএমই) ঋণে ভর্তুকি পেয়েছে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে সুদ ভর্তুকির জন্য চাহিদাপত্র দিয়েছিলাম। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এসব ঋণ যাচাই–বাছাই করতে বলা হয়েছে। এখন যাচাই–বাছাই চলছে। তা শেষ হলে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হবে। এরপরই সুদ ভর্তুকির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে গত বছরের এপ্রিলে সরকার প্রণোদনা ঋণ ঘোষণা করে। সে অনুযায়ী শিল্প ও সেবা খাতের উদ্যোক্তাদের সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয় ব্যাংকগুলো। ৯ শতাংশ সুদের এই ঋণে বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ ভর্তুকি দেয় সরকার। আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের ব্যবসায়ীদের ৪ শতাংশ সুদে দেওয়া হয় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। এই ঋণের সুদহারও ৯ শতাংশ। এর মধ্যে ৫ শতাংশ সুদ বহন করে সরকার। নিয়ম হলো, প্রণোদনা ঋণে এক বছর পর্যন্ত সুদ ভর্তুকি পাবেন গ্রাহকেরা।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এসব ঋণ যাচাই–বাছাই করতে বলা হয়েছে। এখন যাচাই–বাছাই চলছে। তা শেষ হলে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হবে। এরপরই সুদ ভর্তুকির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে গভর্নরকে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক যাচাই–বাছাই করে সুদ ভর্তুকির পরবর্তী প্রস্তাব প্রতিবেদনসহ অর্থ বিভাগে পাঠাবে। অর্থ বিভাগ থেকে সুদ ভর্তুকি গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা ব্যাংকগুলোকে দেয়।
কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানান, ছোট ও বড় যেসব গ্রাহক প্রণোদনা ঋণ নিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই মূল টাকা ও সুদ—দুটিই শোধ করছেন। বাকি সুদ সরকারের তরফ থেকে আসার কথা। এই টাকা এলে ব্যাংকগুলো ঋণ না দিলেও মুদ্রাবাজারে খাটিয়ে কিছু আয় করতে পারত।
অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, শিল্প ও সেবা খাতে দেওয়া বড় ঋণের ব্যবহার খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এতে বড় ধরনের অনিয়মও পাওয়া যাচ্ছে। ঋণের বড় অংশের যথাযথ ব্যবহার হয়নি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের ঋণ ছোট অঙ্কের হওয়ায় সেটির ব্যবহার খতিয়ে দেখা অসম্ভব। কারণ, এক লাখের বেশি গ্রাহক ঋণ পেয়েছেন। এই ঋণের তথ্য চাইলে ব্যাংকগুলো বস্তা ভরে নথিপত্র পাঠাবে। এত গ্রাহকের খোঁজ নেওয়া সম্ভব নয়।
জানা গেছে, প্রণোদনা তহবিল থেকে শিল্প ও সেবা খাতে সরকারি সংস্থা বিমান বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে সোনালী ব্যাংক থেকে। অন্য উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানে মধ্যে আবুল খায়ের গ্রুপ ঋণ ১ হাজার ১৭১ কোটি টাকা, এস আলম গ্রুপ ১ হাজার ৮৬ কোটি টাকা, সিটি গ্রুপ ৮২৭ কোটি টাকা ও বসুন্ধরা গ্রুপ ৬৭৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর বাইরে বিএসআরএম ৬৪১ কোটি টাকা, নোমান গ্রুপ ৫৯৯ কোটি টাকা, প্রাণ গ্রুপ ৫৫৯ কোটি টাকা, মেঘনা গ্রুপ ৩৭১ কোটি টাকা, কেএসআরএম ৩২৮ কোটি টাকা, এসিআই ৩২৭ কোটি টাকা, জিপিএইচ ২৯০ কোটি টাকা, নাভানা ২৬৮ কোটি টাকা, বেক্সিমকো ২৬০ কোটি টাকা, থার্মেক্স গ্রুপ ২৩৮ কোটি টাকা, যমুনা গ্রুপ ২১৯ কোটি টাকা, নাসা গ্রুপ ১৮৫ কোটি টাকা ও ইউনিটেক্স গ্রুপ ১৮৩ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিউল আলম খান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘চলতি বছরে এখন পর্যন্ত সরকারের সুদ ভর্তুকির কোনো টাকা আমরা পাইনি। বেশির ভাগ গ্রাহক তাঁদের কিস্তি পরিশোধ করছেন। এতে মূল ও সুদ উভয়ই ফেরত আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে, শিগগিরই সরকার সুদ ভর্তুকির টাকা দেবে।’