ব্যাংকের ঋণে বিদেশ যাওয়ার আগ্রহ বাড়ছে

অনেক বেকার যুবকই আছেন, যাঁরা বিদেশে গিয়ে কাজ করতে চান। এমন অনেক নারীও আছেন। দেশে যে কাজ করতে চান না, তা করতে রাজি তাঁরা বিদেশে গিয়ে। এসব যুবক ও নারী মা-বাবা ও সন্তানের জন্য প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) পাঠাবেন দেশে, তার বদলে একটু স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন চান। তাঁদের কষ্টের আয়ে দেশ পাবে বৈদেশিক মুদ্রা; কিন্তু বিদেশে যাওয়ার পয়সা জোগাড়ে অনেককে হিমশিম খেতে হয়।

বিদেশ যেতে ইচ্ছুক এসব যুবক ও নারীকে সহায়তার জন্যই সরকার একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে, যার নাম প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক। নামের সঙ্গে ‘কল্যাণ’ শব্দটি যুক্ত থাকা একমাত্র ব্যাংক এটি। বিদেশ যেতে ইচ্ছুক বেকার যুবক ও নারীদের এ ব্যাংক তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিচ্ছে। মাসে মাসে এ ঋণ শোধ করার সুযোগ রয়েছে। তবে বিদেশে গিয়ে সবাই সফল হতে পারেন না। ভালো কাজ না পাওয়ায় বা বিদেশে মন না টেকায় অনেকে ফিরে আসেন দেশে। বিদেশ থেকে ফিরে আসা জনশক্তির আত্মকর্মসংস্থানের জন্যও ঋণের ব্যবস্থা রয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকে। এ ঋণের জন্য কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রাখতে হয় না। প্রয়োজনীয় সব নথিপত্র ঠিক থাকলে আবেদনের সাত দিনের মধ্যেই ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় ব্যাংক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ২০ এপ্রিল প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের উদ্বোধন করেন। চারটি উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয় এ ব্যাংক। এগুলো হচ্ছে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক বেকারদের সহায়তা, দেশে ফিরে আসার পর তাঁদের কর্মসংস্থানে সহায়তা, প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে বিনিয়োগে সহায়তা এবং আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত ও ব্যয় সাশ্রয়ী উপায়ে দেশে প্রবাসী আয় পাঠাতে সহায়তা।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই ব্যাংকটিকে তফসিলি বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। যত দিন যাচ্ছে, এ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণকারীর সংখ্যাও তত বাড়ছে। বর্তমানে সারা দেশে ব্যাংকটির ১২২টি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে জেলা পর্যায়ে ৬৫টি ও উপজেলা পর্যায়ে ৫৭টি। এ ছাড়া আছে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১টি আগমনী ও ১টি বহির্গমন বুথ।

ব্যাংকটির অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধনের ৯৫ শতাংশ দিয়েছে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড এবং ৫ শতাংশ দিয়েছে সরকার। পরিশোধিত মূলধন দুই হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হওয়ার চূড়ান্ত অনুমোদনের ফাইল এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে আছে বলে জানা গেছে।

প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক জানায়, ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১ লাখ ৭০ হাজার ১৯৪ জন প্রবাসীকে ৩ হাজার ৩১১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। ব্যাংকটি প্রথমবার; অর্থাৎ ২০১১-১২ অর্থবছরে ৮৯৯ জনকে ৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ঋণ দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল।

ঋণ দেওয়া হয় ভিসার মেয়াদের ওপর ভিত্তি করে। ঋণের সর্বোচ্চ পরিমাণ তিন লাখ টাকা। নতুন ভিসার ক্ষেত্রে ঋণের মেয়াদ তিন বছর। আর রি-এন্ট্রি ভিসার ক্ষেত্রে মেয়াদ দুই বছর। ঋণ পরিশোধে গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে দুই মাস। সুদের হার ৯ শতাংশ (সরল সুদ)।

প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এ ঋণের জন্য সাধারণত সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন—এসব দেশে গমনে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা বেশি আবেদন করেন। ইতালি, রোমানিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর যাওয়ার ক্ষেত্রেও ঋণের আবেদন বাড়ছে দিন দিন।

ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা

ঋণের জন্য আবেদন করতে কোনো টাকা লাগে না। আবেদন করতে হয় ব্যাংকের নির্ধারিত ফরমে। তবে ঋণ নেওয়ার আগে ব্যাংকে হিসাব খুলতে হবে গ্রাহককে। ঋণ পাওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে বৈধ ভিসা। বৈধ ভিসার পাশাপাশি বিদেশগামী কর্মীকে যে কোম্পানি কাজ দেবে বা নিয়োগ করবে, সেই কোম্পানির দেওয়া নিয়োগপত্র লাগবে।

এ ছাড়া লাগবে আবেদনকারীর সত্যায়িত চার কপি পাসপোর্ট আকারের ছবি, বর্তমান ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানাসংবলিত পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নেওয়া সনদ, পাসপোর্ট ও ভিসার কপি, ম্যানপাওয়ার স্মার্ট কার্ডের ফটোকপি এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) ফটোকপি।

ঋণ পাওয়ার আবেদনপত্রের সঙ্গে আরও লাগবে দুজন জামিনদারের এক কপি করে পাসপোর্ট আকারের ছবি, এনআইডি, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানাসংবলিত পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নেওয়া সনদ এবং জামিনদারদের যেকোনো একজনের স্বাক্ষর করা ব্যাংকের তিনটি চেকের পাতা। প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আবেদনের প্রক্রিয়া শেষ করার পর প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক আবেদনকারীকে মুঠোফোনে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়ে ঋণ অনুমোদনের তথ্য জানিয়ে দেয়।

কত ধরনের ঋণ ও সেবা

ছয় ধরনের ঋণ দেয় প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক। এগুলো হচ্ছে অভিবাসী ঋণ, পুনর্বাসন ঋণ, বিশেষ পুনর্বাসন ঋণ, বঙ্গবন্ধু অভিবাসী বৃহৎ পরিবার ঋণ, আত্মকর্মসংস্থানমূলক ঋণ এবং নারী অভিবাসন ও পুনর্বাসন ঋণ। ঋণের কিস্তি জমা দেওয়ার কাজ সহজ করতে এ ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে। ফলে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের পাশাপাশি সোনালী ব্যাংকের যেকোনো শাখার মাধ্যমেও কিস্তি জমা দেওয়া যায়।

ঋণসেবার পাশাপাশি অভিবাসী কর্মী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য ব্যাংকটিতে বিভিন্ন ধরনের আমানত প্রকল্পও রয়েছে। এগুলো হচ্ছে বঙ্গবন্ধু সঞ্চয়ী স্কিম, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা সঞ্চয়ী স্কিম, বিবাহ সঞ্চয়ী স্কিম, বঙ্গবন্ধু ডাবল বেনিফিট সঞ্চয়ী স্কিম ও পিকেবি স্কুল ব্যাংকিং সঞ্চয়ী স্কিম। আমানতের সুদ কম হওয়ায় এসব স্কিমে জনগণের সাড়া কম বলে জানা গেছে।

অভিবাসী ঋণ গ্রহণকারী সবাইকে চাঁদা দিয়ে ‘ঋণ ঝুঁকি আচ্ছাদন স্কিম’-এর সদস্য হতে হয়। এ স্কিমের তহবিল থেকে ঋণের মেয়াদকালে যদি কোনো গ্রাহক মারা যান, তাহলে যত টাকা বাকি থাকবে (ঋণ স্থিতি), তার পুরোটা; অর্থাৎ ১০০ শতাংশ টাকাই মওকুফ করে দেওয়া হয়। আর ঋণ নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে ঋণ গ্রহণকারী যদি বিদেশ থেকে ফেরত আসেন, তাহলে ঋণ স্থিতির অর্ধেক; অর্থাৎ ৫০ শতাংশ টাকা মওকুফ করা হয়। প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ঋণ নেওয়ার পর দেশে বা বিদেশে মৃত্যুবরণকারী ১৬৮ জনের ঋণের ২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা মওকুফ
করা হয়েছে।

প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মজিবুর রহমান বলেন, ‘কোনো ব্যাংক আসল টাকা মাফ করে না। কিন্তু আমাদের ব্যাংকের একটা বিশেষ দিক হচ্ছে গ্রাহক বিদেশে মারা গেলে আমরা আসলও মাফ করে দিই। বিদেশফেরত নারীদের আত্মকর্মসংস্থানে ৪ থেকে ৭ শতাংশ সুদে ঋণ দিই। আর আমরা যেহেতু কল্যাণে কাজ করি, তাই ব্যাংকের সুদ বৃদ্ধির এই সময়েও অভিবাসী ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশই বহাল রেখেছি।’

খেলাপি ঋণের হার কেমন, এমন প্রশ্নের জবাবে মজিবুর রহমান বলেন, দুই বছর আগেও এ হার ছিল ১২ শতাংশ। ১৫টি আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ায় খেলাপি হার ৭ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে।