কৌশলে ভালো ‘ঋণমান’ আদায় করছে অনেক ব্যাংক
বিভিন্ন কৌশলে ভালো রেটিং বা ঋণমান করিয়ে নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এ জন্য কোনো কোনো ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হলেও তাদের ক্রেডিট রেটিং, অর্থাৎ ঋণমান খারাপ দেখাচ্ছে না। এ অভিযোগ অবশ্য বেশ পুরোনো। এতে নতুন মাত্রা দিয়েছে খোদ ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থাগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিস ইন বাংলাদেশ।
সংগঠনটি অভিযোগ করেছে, অনেক ব্যাংক প্রাপ্য রেটিং না নিয়ে উচ্চতর রেটিং বা মান দেওয়ার জন্য ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থাগুলোর কাজে হস্তক্ষেপ করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় চাপ প্রয়োগ করে ভালো রেটিং না নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকে গত রোববার অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সভাপতিত্ব করেন। এতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অ্যাসোসিয়েশন অব ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিস ইন বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক সভায় উচ্চতর রেটিং পেতে ব্যাংকগুলোর হস্তক্ষেপ করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এটা রোধ করা না গেলে ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ হিসাবায়নের প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে অনুযায়ী রোববারের ব্যাংকার্স সভায় বিষয়টি ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে হস্তক্ষেপ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অ্যাসোসিয়েশন অব ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিস ইন বাংলাদেশের অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেন। নাম প্রকাশে অনীহা জানিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কিছু ব্যাংকের মালিক গ্রাহকদের গচ্ছিত আমানতের টাকা নামে-বেনামে তুলে নিয়ে ব্যাংক ফাঁকা করে ফেলেছেন। তা সত্ত্বেও তাদের ব্যাংকের ক্রেডিট রেটিংয়ে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ জন্য ওই সব ব্যাংকের ঋণমানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
অনেক ব্যাংক ভালো রেটিং দেওয়ার চাপ প্রয়োগ করে। এতে ব্যাংকগুলোর ব্যবসা করতে সুবিধা হয়। আর্থিক প্রতিবেদন ভালো না থাকলে রেটিং ভালো দেওয়া যায় না। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা প্রয়োজন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা চাইলে এটা দূর করা সম্ভব।মুজাফফর আহমেদ, প্রতিষ্ঠাতা, ক্রেডিট রেটিং ইনফরমেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (ক্রিসল)।
ওই এমডি আরও বলেন, প্রভাব খাটিয়ে ঋণমান আদায় করে নেওয়া ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়, তাতেই কেবল এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। তখন ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর ঋণমানের প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে।
দেশে বর্তমানে যেসব রেটিং এজেন্সি বা ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা রয়েছে সেগুলো হচ্ছে—ক্রেডিট রেটিং ইনফরমেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (ক্রিসল), ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি অব বাংলাদেশ (ক্র্যাব), ইমার্জিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড (ইসিআরএল), ন্যাশনাল ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড, আর্জুস ক্রেডিট রেটিং সার্ভিসেস লিমিটেড, আলফা ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড, ডব্লিউএএসও ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি ও দ্য বাংলাদেশ রেটিং এজেন্সি লিমিটেড।
জানা যায়, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমোদন প্রাপ্ত ও বাংলাদেশ ব্যাংকে তালিকাভুক্ত। এসব ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে তাদের দেওয়া ঋণের মান রেটিং বা নির্ণয় করাতে হয়। কোন প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট রেটিং করবে, তা ব্যাংকগুলো নিজেরাই ঠিক করে। নিজেদের চাহিদামতো ঋণমান নির্ণয়কারী কোনো প্রতিষ্ঠান এক বছর রেটিং না দিলে তারা পরের বছর অন্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকগুলোর কাছে একরকম জিম্মি হয়ে থাকে।
আবার যেসব রেটিং এজেন্সি মানসম্মত নয়, তারা কাজের আশায় ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী রেটিং করে দেয়। ফলে কোনো বছর কোনো ব্যাংকে বড় ধরনের অনিয়ম হলেও তাদের রেটিংয়ে তেমন হেরফের হয় না। এমনকি আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হয়ে পড়লেও রেটিং খারাপ হয় না। বরং আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হলে রেটিং ভালো থাকার প্রচার করতেও দেখা যায় ব্যাংকগুলোকে। ফলে রেটিংয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই একধরনের প্রশ্ন রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা চাইছেন, ব্যাংকগুলোর রেটিং যথাযথভাবেই করা হোক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অ্যাসোসিয়েশন অব ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিস ইন বাংলাদেশ আরও জানিয়েছে, অনেক ব্যাংক মেয়াদোত্তীর্ণ রেটিং ব্যবহার করছে। আবার অনেক ব্যাংক চুক্তি ছাড়াই রেটিং সম্পন্ন করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব বিষয়ে ব্যাংকারদের নির্দেশনা দিয়েছে।
দেশের ক্রেডিট রেটিং চালুর অন্যতম প্রবক্তা মুজাফফর আহমেদ। তিনি ক্রেডিট রেটিং ইনফরমেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (ক্রিসল) প্রতিষ্ঠাতা। সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মুজাফফর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক ব্যাংক ভালো রেটিং দেওয়ার চাপ প্রয়োগ করে। এতে ব্যাংকগুলোর ব্যবসা করতে সুবিধা হয়। আর্থিক প্রতিবেদন ভালো না থাকলে রেটিং ভালো দেওয়া যায় না। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা প্রয়োজন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা চাইলে এটা দূর করা সম্ভব।’