প্রথম আলো: ১৯৮৩ সালে সিটি ব্যাংক গড়ে তোলার প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য কী ছিল?
মাসরুর আরেফিন: ১৯৭২ সালে দেশের অর্থনীতি ছিল মাত্র ৮০০ কোটি ডলারের। এ অবস্থায় শিল্প-বাণিজ্যে গতিশীলতা আনতে প্রয়োজন ছিল দেশীয় উদ্যোক্তা ও পুঁজির। আমাদের ব্যাংকটা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে ছিলেন ১২ জন সাহসী ব্যবসায়ী। ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা মূলধন দিয়ে দেশের প্রথম লাইসেন্স পাওয়া এই ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। সেই মানুষগুলোর নাম ব্যাংকের ৪০তম জন্মদিনে নিতেই হয়। তাঁরা হলেন এম এ হাসেম, আনোয়ার হোসেন, দীন মোহাম্মদ, ইব্রাহিম মিয়া, আজিজুল হক চৌধুরী, আব্দুল হাদী, আব্দুল বারিক চৌধুরী, এন এ চৌধুরী, মনোয়ার আলী, এ কে মেহমুদ, মো. আলী হোসেন ও এ বি এম ফিরোজ। ১৯৮৩ সালের ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে এই ব্যাংকের প্রথম শাখা উদ্বোধন হয়।
প্রথম আলো: এই ৪০ বছরে আপনাদের মূল অর্জনগুলো কী কী?
মাসরুর আরেফিন: আমাদের আমেরিকান এক্সপ্রেস কার্ড এখন দেশের কার্ড ব্যবসায়ে সবচেয়ে বেশি শেয়ার নিয়ে আছে। মূলধন শক্তিশালী করার জন্য টিয়ার-২ বন্ডের সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রথম ৪০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত টিয়ার-১ পারপেচুয়াল বন্ড আমরাই ইস্যু করি। এই পথ অনুসরণ করে পরে অনেক ব্যাংক তাদের মূলধনের প্রয়োজন মিটিয়েছে। আমাদের আরেক বড় অর্জন হলো, বিশ্বব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আইএফসিকে একক সর্বোচ্চ শেয়ারহোল্ডার হিসেবে ব্যাংকের পর্ষদে নিয়ে আসা। আমাদের সঙ্গে আইএফসি আছে মানে গ্রাহকেরা এ ব্যাংকের সুশাসন ও শৃঙ্খলার ব্যাপারে আস্থা রাখতে পারেন। আর গ্রাহক আস্থার নামই ব্যাংকিং। করপোরেট ব্যাংকিংয়ে আমাদের সাফল্য অনেক বড়। গত ১৫ বছরে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ২২ শতাংশ আমাদের অর্থায়নে হয়েছে। আমাদের ব্যাংকে ৮ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করছে। ৮ হাজার পরিবার এই ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল। সেটাও একটা বড় কথা।
প্রথম আলো: ২০০৭ সালে সিটি ব্যাংক ‘প্রবলেম ব্যাংক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। এরপর ঘুরে দাঁড়াল কীভাবে?
মাসরুর আরেফিন: ৪০ বছরে সিটি ব্যাংকের অর্জন অনেক। আমরা এ দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সফল ‘ট্রান্সফরমেশন’ বা ‘রূপান্তর’ সম্পন্ন করা ব্যাংক। প্রথম প্রজন্মে যাত্রা শুরু করে এই ব্যাংক পথ ভুলে একসময় ‘প্রবলেম ব্যাংক’ হয়ে গিয়েছিল। ২০০৭ সালে তৎকালীন চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার ভাবলেন, এই ব্যাংকের সম্পূর্ণ ‘ট্রান্সফরমেশন’ করতে হবে। তাঁকে পর্ষদের বাকি সবাই সমর্থন দিলেন। ব্যাংকে যোগ দিল আমার মতো মূলত বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা একদল তরুণ ব্যাংকার।
পর্ষদের সম্মতি নিয়েই আমরা ঠিক করলাম, প্রথাগত করপোরেট ব্যাংকিং চালু রেখে সিটি ব্যাংককে একটি ফাইন্যান্সিয়াল সুপারমার্কেট হিসেবে গড়ে তুলব। এরপর চালু হলো আমেরিকান এক্সপ্রেস কার্ড, ব্যাংকের নতুন লোগো, রিটেইল ঋণ, স্মল লোন, সিটিজেম প্রায়োরিটি ব্যাংকিং। আরও পরে চালু করা হয় সিটি আলো নারী ব্যাংকিং, সিটিটাচ ইন্টারনেট বা ডিজিটাল ব্যাংকিং।
প্রথম আলো: আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্র্যান্ডের কারণে ক্রেডিট কার্ড মানেই সিটি ব্যাংক। রিটেইল ব্যবসায়ও নজর বেশি আপনাদের। কেমন সাড়া মিলছে?
মাসরুর আরেফিন: রিটেইল বিজনেস ও ক্রেডিট কার্ড দুই জায়গাতেই আমাদের নজর অত্যন্ত বেশি। প্রায় ৩০ লাখ গ্রাহক আমাদের রিটেইল ও ক্রেডিট কার্ডের সেবা পাচ্ছেন। আমাদের রয়েছে সিটিটাচ ইন্টারনেট ব্যাংকিং, যেখানে ব্যক্তি পর্যায়ের গ্রাহকেরা গত বছরে মোট ৩৮ হাজার কোটি টাকার লেনদেন করেছেন শুধু তাঁদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। এটা বিরাট ব্যাপার। গত আড়াই মাসে যেখানে অনেক ব্যাংকের আমানত কমেছে সেখানে আমাদের প্রকৃত আমানত বেড়েছে ২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, যার বড় অংশই ব্যক্তি আমানতকারী। এতেই বোঝা যায়, এই ব্যাংকের ওপর মানুষের কত ভরসা। ১০ কোটি কর্মক্ষম মানুষের এই দেশে সবার জন্য ব্যাংকিংয়ের সুযোগ থাকতে হবে। আর ঋণও বিকেন্দ্রীকরণ করতেই হবে, না হলে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে।
প্রথম আলো: এসএমই খাতই দেশের অর্থনীতির প্রাণ। এই খাতে আপনাদের অবস্থান কেমন। খাতটির উদ্যোক্তারাই–বা কেমন করছেন বলে মনে করেন?
মাসরুর আরেফিন: আমাদের এসএমই খাত একদম আলাদা দুই ভাগে বিভক্ত। মাঝারি উদ্যোক্তা ঋণ এবং ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ঋণ। এ দুই খাতে আমাদের মোট ঋণ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মাঝারি উদ্যোক্তা খাতে সাড়ে ৪ হাজার কোটি এবং ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ঋণ খাতে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের পর থেকে মাঝারি উদ্যোক্তা খাতে দেওয়া একটা ঋণও মন্দ হয়নি। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রণোদনামূলক প্যাকেজের কারণে আমরা এই দুই খাতে আরও অনেক ভালো করব।
প্রথম আলো: করপোরেট গ্রাহকেরা এ সময়ে কেমন করছেন? ডলার–সংকট তাদের ব্যবসায়ে কেমন প্রভাব ফেলেছে? এর সমাধান কীভাবে হবে?
মাসরুর আরেফিন: বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে বৈশ্বিকভাবেই ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। দেশে মুদ্রাস্ফীতি, সরবরাহব্যবস্থায় বিপর্যয়, আমদানি সংকোচনসহ নানা কারণে আমাদের করপোরেট গ্রাহকেরাও তাঁদের ব্যবসায়ে ধীরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্যাংকগুলোর ঋণের কিস্তি ফেরত পাওয়ার ঝুঁকি দিন দিন বেড়ে চলেছে।
ডলার–সংকট থাকলেও গত জানুয়ারি মাসে আমাদের চলতি হিসাবে ২২ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। তার মানে, আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। এখন স্থায়ী সমাধান হিসেবে রপ্তানি পণ্য ও রপ্তানি বাজারের বহুমুখীকরণ করতে হবে। দেশের যত মানুষ শ্রমিক হিসেবে বাইরে গেছেন, তাতে যে ৩৫-৪০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় দেশে আসার কথা, সেটা আনতে হবে। বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার পুরো বন্ধ করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। বর্তমান গভর্নর মহোদয় এগুলো নিয়ে কাজ করছেন।
প্রথম আলো: ঋণের সুদহার নতুন করে নির্ধারণ করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ট্রেজারি বিল বা বন্ডের সঙ্গে সুদহার বাড়বে-কমবে, এমনটা হলে কেমন হবে?
মাসরুর আরেফিন: কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটা বাজারভিত্তিক রেফারেন্স রেট ঠিক করতে যাচ্ছে, যা ঝুঁকিমুক্ত সভরেন বিনিয়োগ অর্থাৎ ট্রেজারি বিল বা বন্ডের ওপর ভিত্তি করে হবে। এটা ভালো লাগছে যে সোফর বা লাইবরের মতো আমাদের আর্থিক বাজারেও একটা বেঞ্চমার্ক রেট থাকবে, যার ওপর ভিত্তি করে ব্যাংকগুলোর আমানত ও ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে। এই বেঞ্চমার্ক রেট একটা রিস্ক ফ্রি রেট। সিটি ব্যাংকের সুনাম বেশি বলে সে ডিপোজিট আনতে এর ওপর প্রিমিয়াম দেবে কম। অন্যদিকে যে ব্যাংকের দুর্নাম বেশি সেটি ওইটার ওপরে প্রিমিয়াম দেবে বেশি। তবে বেঞ্চমার্ক রেট নির্ধারণের বেলায় চ্যালেঞ্জ হলো ট্রেজারি বিল বা বন্ডের প্রাপ্তিহার হতে হবে বাজারভিত্তিক। নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ বেশি হলে কাঙ্ক্ষিত সুফল কম পাওয়া যাবে।
প্রথম আলো: স্বল্পমেয়াদি আমানতের অর্থে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এ কারণে ঋণগুলো খেলাপি হয়ে পড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন গভর্নর। এটা কীভাবে কমানো সম্ভব?
মাসরুর আরেফিন: এ কথা সত্যি যে ব্যাংকগুলো নিরুপায় হয়েই স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি আমানতের উৎস হচ্ছে বন্ড মার্কেট, যা আমাদের দেশে বলতে গেলে নেই। ঋণখেলাপি হওয়ার পেছনে ব্যাংকের তারল্যঝুঁকির ভূমিকা আসলে কম। খেলাপি ঋণের মূলে আছে ব্যাংকের পর্ষদগুলোয় বেনামি ঋণ দেওয়ার চাপের সংস্কৃতি ও জবাবদিহির অভাব। তবে শক্ত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা দিয়ে খেলাপি ঋণ কমানোর আয়োজন করতে পারলেও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সামগ্রিক অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলানোর সক্ষমতা দেওয়াটাও জরুরি। এখানেই জরুরি হচ্ছে বাজেট প্রণয়নের আগে ব্যবসায়ীদের কথা শোনা। ব্যবসায়ী সমিতিগুলো কী বলতে চায়, সেটা রাজস্ব বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের শোনা দরকার।
প্রথম আলো: সামনের দিনে সিটি ব্যাংককে কোথায় দেখতে চান। আপনার সময়ের অর্জন ও পরিকল্পনাগুলো কী কী?
মাসরুর আরেফিন: আমি এমডি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে ব্যাংকের মোট আয় ছিল ১ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। সেটা ৪ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ৬৬৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা। আর সিটি ব্যাংকের নিট মুনাফা ২০২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৪৭৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। আমাদের শীর্ষ কর্মকর্তারা ব্যাংক খাতের সেরা। এর চেয়ে বড় কথা হলো, দূরদর্শী ও পেশাদার চেয়ারম্যান পাওয়া। আমাদের পরিচালনা পর্ষদের কেউ আজ পর্যন্ত কারও নামে বা বেনামে কোনো ঋণ দিতে বলেননি। কেনাকাটার জন্যও কেউ কোনো সুপারিশ করেননি। বাংলাদেশের ব্যাংকিং–সংস্কৃতিতে এ ধরনের সুশাসন স্বপ্নের মতো। সেটার ওপরে ভর করেই সামনের দিনে আরও বেশি গ্রামবাংলামুখী কার্ড ও ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসা শুরু করতে চাই। সিটি ব্যাংককে এক শ ভাগ ডিজিটাল ব্যাংক এবং গ্রিন ও টেকসই ব্যাংক হিসেবে গড়ে তোলা আমার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণ করার আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের জন্য আরও বেশি মুনাফা করতে চাই। বেশি মুনাফা মানেই মূলধনের পর্যাপ্ততা এবং গণমানুষের জন্য বেশি বেশি নতুন সেবা আনার আর্থিক সক্ষমতা। বেশি মুনাফা মানে সরকারকে বেশি রাজস্ব দেওয়াও বোঝায়। ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে সরকার সেটা পেলে আমাদের ব্যাংকারদের নৈতিক দায় কিছুটা মেটে। এই সেক্টরকে নৈতিকভাবে ঠিক হওয়ার সময় এসেছে।
প্রথম আলো: আমানতের সুদ থেকে যা মিলছে, তাতে মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। এর সমাধান কী?
মাসরুর আরেফিন: স্বাভাবিক নিয়মেই তা সামাল দিতে পারার কথা নয়। আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির চাইতে কম হলে আমানত কমে যায়। মূল্যস্ফীতি যদি থাকে ৫ শতাংশ এবং ১ বছরের সুদহার হয় ৫ শতাংশ, তাহলে ১০০ টাকা দিয়ে ১ বছর পরও সমপরিমাণ পণ্য কেনা সম্ভব। কিন্তু মূল্যস্ফীতি যদি হয় ১০ শতাংশ, তাহলে ১ বছর পর ওই ১০০ টাকার সমপরিমাণ পণ্য কিনতে ঘাটতি হবে ৫ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব হচ্ছে ওই ৫ টাকা আমানতকারীদের পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া। পণ্যের দাম ৫ টাকা কমিয়ে দেওয়া গেলেও হতো, কিন্তু তার ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো হাত নেই। তাই মুদ্রানীতির মাধ্যমে আমানতকারীদের ভোগ কমিয়ে আমানত সংরক্ষণের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি কমানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকরী উপায় হচ্ছে, বাজার থেকে তারল্য কমিয়ে দিয়ে সুদহার বাড়ানো। কিন্তু যত যা-ই বলি, অন্যান্য সমগোত্রীয় দেশের মূল্যস্ফীতির বর্তমান হারের দিকে তাকালে আমি বেশ শান্তিই পাই।