বিশেষ বন্ডে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে শরিয়াহ ব্যাংক, পাবে বিনা খরচে টাকা

  • টাকার অভাবে সার ও বিদ্যুতের দেনা মেটাতে ইতিমধ্যে পাঁচ ব্যাংককে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বন্ড দেওয়া হয়েছে। 

  • সার ও বিদ্যুতে বেসরকারি খাত ও সরকারি সংস্থার পাওনা প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা।

টাকাপ্রতীকী ছবি

টাকার সংকটের পরিস্থিতিতে সরকার সার ও বিদ্যুতের বকেয়া মেটাতে ব্যাংকগুলোকে বিশেষ বন্ড দিচ্ছে। প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোকে বন্ডের বিপরীতে ৮ শতাংশ সুদ দেওয়া হচ্ছে। একই সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সমপরিমাণ অর্থ নিতে পারছে ব্যাংকগুলো, যা ঋণ বা বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে তারা। তবে বকেয়ার বিপরীতে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোকে দেওয়া বন্ডে কোনো সুদ দিচ্ছে না সরকার। এ জন্য এই বিশেষ বন্ডের বিপরীতে বিনা খরচে টাকা ধার দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে খোলা হচ্ছে বিশেষ হিসাব। সেই হিসাব থেকে এই অর্থ দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

এদিকে টাকার সংকটে পাঁচ ইসলামি ব্যাংককে কোনো জামানত ছাড়া নির্দিষ্ট সুদে নিয়মিত টাকা ধার দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এভাবে কত দিন চলবে, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

বকেয়ার বিপরীতে ইসলামি ব্যাংকগুলোকে দেওয়া বন্ডে সুদ দিচ্ছে না সরকার। এই বন্ডের বিপরীতে বিনা খরচে টাকা ধার দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

টাকার অভাবে সার ও বিদ্যুতের দেনা মেটাতে ইতিমধ্যে পাঁচ ব্যাংককে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বন্ড দেওয়া হয়েছে। সরকারের কাছে সার ও বিদ্যুতে বেসরকারি খাত ও সরকারি সংস্থার পাওনা প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুতে ১৪ হাজার কোটি টাকা, আর সারে ১২ হাজার কোটি টাকা বকেয়া। ইতিমধ্যে সারের বকেয়া পরিশোধে ইসলামী ব্যাংককে ২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংককে ২৫৫ কোটি টাকা ও আইএফআইসি ব্যাংককে ৪৫৯ কোটি টাকার বন্ড দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধে সিটি ব্যাংককে ১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ও পূবালী ব্যাংককে ৭৭ কোটি টাকার বন্ড দেওয়া হয়েছে।

প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো এই বন্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রেখে ১৮০ দিন পর্যন্ত মেয়াদে বন্ডের সমপরিমাণ টাকা ধার নিতে পারছে। এতে বাড়ছে মুদ্রা সরবরাহ। আর্থিক সংকটে থাকা সরকারকে বাংলাদেশ ব্যাংক একসময় টাকা ছাপিয়ে ঋণ দিত। তবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সে পথ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরে আসে। এখন সরকার দেনা মেটাতে বন্ড দিচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। সেই বন্ডের বিপরীতে টাকা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো টাকা পেলেও ইসলামী ব্যাংক পায়নি। ব্যাংকটি সরকারের কাছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা পাবে। এই ব্যাংকের কাছে বড় অঙ্কের টাকা আটকে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নির্ধারিত তারল্য জমা রাখতে পারছে না ব্যাংকটি। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে ঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ জন্য বন্ডের বিপরীতে বিনা সুদে টাকা ধার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

১১ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শরিয়াহ পরামর্শক কমিটির এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে দেওয়া মুনাফাবিহীন বন্ড ও শরিয়াহভিত্তিক বিশেষ বন্ডকে জামানত হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক কোনো মুনাফা গ্রহণ ছাড়াই তারল্যসুবিধা প্রদান করা হলে তা শরিয়াহসম্মত হবে। তবে কোনো মুনাফা গ্রহণ ছাড়া এ ধরনের বিশেষ বন্ডের বিপরীতে তারল্যসুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নেওয়া যথাযথ হবে। এই প্রেক্ষাপটে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মুনাফাবিহীন শরিয়াহভিত্তিক বিশেষ বন্ড জামানত রেখে মুনাফাবিহীন ৯০ দিন ও ১৮০ দিন মেয়াদি বিশেষ তারল্যসুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ক্ষেত্রে বন্ডের ৫ শতাংশ জমা রেখে অবশিষ্ট অর্থ বিশেষ তারল্য হিসেবে ব্যাংকগুলোকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

দেশে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ১০টি হলেও চরম তারল্যসংকটে রয়েছে পাঁচটি। সেই ব্যাংকগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। ব্যাংক পাঁচটি একই গ্রুপের মালিকানাধীন। ১১ জানুয়ারি নগদ জমা (সিআরআর) বাবদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ইসলামী ব্যাংকের জমা রাখার প্রয়োজন ছিল ৬ হাজার ৬৫ কোটি টাকা, তবে সেদিন ব্যাংকটির চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৩ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। তাতে তাদের সার্বিক ঘাটতি দাঁড়ায় ৯ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ৮ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৫২১ কোটি টাকা। চলতি হিসাবের ঘাটতিতে থাকা এসব ব্যাংকের লেনদেন বিশেষ ব্যবস্থায় চালু রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

আজ বন্ড পাচ্ছে দুই ব্যাংক

বিদ্যুৎ খাতে ১৪ হাজার কোটি টাকা বকেয়ার মধ্যে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। আজ দুই ব্যাংককে আরও দুই হাজার কোটি টাকার বেশি বন্ড দেওয়া হবে। ব্যাংক দুটি হলো ব্যাংক এশিয়া ও ইস্টার্ণ ব্যাংক।

ব্যাংকাররা বলছেন, বকেয়ার বিপরীতে বন্ড দেওয়ায় সরকার ও ব্যাংক—উভয়ের সুবিধা হয়েছে। কারণ, বকেয়া টাকা পেয়েছে ব্যাংকগুলো, আবার সরকারও আপাতত দেনামুক্ত হয়েছে। তবে রাজস্ব আদায় না বাড়লে ও ভর্তুকি না কমালে শেষ পর্যন্ত টাকা ছাপিয়ে সরকারের ঋণ শোধ করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে, যা মূল্যস্ফীতির ওপর আরও চাপ তৈরি করবে বলে মনে করা হয়।