দেশে ডলার-সংকটের কারণে সিমেন্টশিল্পের কাঁচামাল (ক্লিঙ্কার, স্লাগ, লাইমস্টোন, ফ্লাই অ্যাশ ও জিপসাম) আমদানিতে বিঘ্ন হচ্ছে। অন্যদিকে ডলার-সংকটকে পুঁজি করে ভালো ব্যবসা করছে দেশের ব্যাংক খাত। ফলে দেশে এখন সবার মধ্যে ব্যাংক খাত সবচেয়ে ভালো আছে বলে মনে করছে দেশের সিমেন্টশিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ)।
বিসিএমএর সভাপতি ও ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির আজ সোমবার মতিঝিলের পূর্বাণী হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ‘ক্লিঙ্কার’-এর ওপর আমদানি শুল্ক প্রতি টনে ৫০০ টাকা থেকে কমিয়ে ২০০ টাকা করার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু বাজেটে উল্টো আরও ২০০ টাকা বাড়িয়ে শুল্ক ৭০০ টাকা করা হয়েছে। এতে উৎপাদনকারীরা হতাশ।
ডলার-সংকটের ফলে ঋণপত্র (এলসি) খোলার জটিলতা নিয়ে আলমগীর কবির বলেন, ডলার-সংকটের কারণে সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানিতে বিঘ্ন হচ্ছে, তাতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ডলারের দাম বাড়ার কারণে ব্যাগপ্রতি সিমেন্টের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা।
আলমগীর কবির বলেন, আগে সামান্য মার্জিন দিয়ে এলসি খোলা যেত। এখন সেটা অনেক ক্ষেত্রে শতভাগ দিতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ব্যাংক থেকে এলসি খুলতে নিরুৎসাহিত করা হয়। এলসি খোলার সময় ডলারের দাম এক থাকে, বিল পরিশোধের সময় দাম হয় আরেক।
ঋণপত্র-সংক্রান্ত দুরবস্থা বিবেচনায় নিলে সিমেন্ট খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা লোকসান করছেন বলেও দাবি করেন বিসিএমএ সভাপতি।
অনেক ব্যাংক এলসিতে মাত্রাতিরিক্ত কমিশন আদায় করছে, এই অভিযোগ করে আলমগীর কবির বলেন, ১০৮ টাকা থেকে শুরু করে ১১৫ কিংবা ১১৬ টাকায় ডলার কিনতে হচ্ছে। আগে কমিশনের যে হার শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ ছিল, তা ক্ষেত্রবিশেষ ১ থেকে ১ দশমিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। বলা যায়, এ ক্ষেত্রে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সবকিছু বিবেচনায় নিলে দেশের সব খাতের মধ্যে ডলারের ব্যবসা করে ব্যাংক খাত ভালো আছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস-সংকটের কারণে নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না সিমেন্টশিল্প। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে স্থানীয় পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের লাইটার জাহাজের ভাড়া ১০ শতাংশ বৃদ্ধির কথা থাকলেও জাহাজমালিকদের সংগঠন ২০ শতাংশ বেশি ভাড়া আদায় করছে। এসব ব্যাপারে সরকারের নজরদারি বাড়ানোর অনুরোধ জানান ব্যবসায়ীরা।
বিসিএমএ বলছে, কোনো শিল্পের প্রধান কাঁচামাল আমদানির ওপর শুল্ক সাধারণত ৫ শতাংশের মতো হয়। কিন্তু বাজেটে নতুন শুল্ক প্রস্তাবের ফলে করভার আগের ৯ থেকে ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হবে। এতে সিমেন্টের দাম বেড়ে ভোক্তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হবে। দুই ধরনের সিমেন্টে দাম বাড়বে ৮ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে সাধারণ মানের যে সিমেন্ট সচরাচর ব্যবহৃত হয়, তাতে দাম বাড়বে ৮ থেকে ১৫ টাকা।
এ ছাড়া সিমেন্ট রপ্তানির ওপর নগদ প্রণোদনার ব্যবস্থা না থাকায় এ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করে সংগঠনটি। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিগত ১১ মাসে এ খাতের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের মতো কমেছে। অন্যদিকে এখন সরকারের মেগা প্রকল্পের কাজও কমেছে।
বিসিএমএ প্রস্তাব করেছে যে কাঁচামাল আমদানিতে পণ্যভেদে যে অগ্রিম আয়কর আছে, তা সর্বোচ্চ দশমিক ৫০ শতাংশ করা যেতে পারে। আর কোনোক্রমে অগ্রিম এই আয়করকে চূড়ান্ত দায় হিসেবে বিবেচনা করা সমীচীন হবে না বলে মত উদ্যোক্তাদের।
এ ছাড়া বিক্রয় পর্যায়ে আরও ২ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর ধার্য করা হচ্ছে। যেহেতু আমদানি পর্যায়ে কাঁচামালের ওপর অগ্রিম আয়কর দিতে হয়, সুতরাং বিক্রয় পর্যায়ে তা আবার নেওয়া হলে বিষয়টি দ্বৈত করের শামিল হয় বলে বিএসএমএ মনে করে। বাজেটের আগে বিষয়টি বিবেচনা করার আশ্বাস দেওয়া হলেও তার কোনো প্রতিফলন হয়নি বলেও জানান উদ্যোক্তারা।
আলমগীর কবির সিমেন্টশিল্পকে ‘অগ্রাধিকার খাত’ হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে বলেন, ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে ঋণপত্র ও ডলার-সংকটের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হোক। তাহলে সিমেন্ট উৎপাদনকারীদের সমস্যা কিছুটা হলেও কমবে। ফলে আবাসন সমস্যার সমাধান, অবকাঠামো উন্নয়নসহ দেশের রাজস্ব, কর্মসংস্থানে এই খাত বিশেষ অবদান রাখতে পারবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইনসি সিমেন্টের প্রধান নির্বাহী মাহমুদ হাসান, বেঙ্গল সিমেন্টের বিক্রয়প্রধান সরোজ কুমার বড়ুয়া, আকিজ সিমেন্টের অডিট ও কমপ্লায়েন্স বিভাগের প্রধান মো. মাসুদ রানা, বসুন্ধরা সিমেন্টের বিক্রয় বিভাগের মহাব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া ও বিসিএমএর নির্বাহী পরিচালক শংকর কুমার রায়।