পুরো আর্থিক খাত সংস্কার করুন, শুধু ব্যাংক খাত নয়: শাহ মো. আহসান হাবীব
প্রথম আলো আয়োজিত ‘ব্যাংক খাতকে কোথায় দেখতে চাই’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়েছেন এ খাতের নীতিনির্ধারক, ব্যাংকের পরিচালক, ব্যাংকার, বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আজ মঙ্গলবার প্রথম আলো কার্যালয়ে এটি অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবীব গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যাংক খাত সম্পর্কে তাঁর মতামত দেন।
ব্যাংক খাতকে কোথায় দেখতে চাই; কোথায় সংস্কার করা প্রয়োজন, তা আমরা সবাই জানি। সবার আগে সুশাসনের বিষয়ে কাজ করতে হবে। যেমন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) কথা বলা যায়। তারা ব্যাংক নাকি ঋণগ্রহীতাদের প্রতিনিধিত্ব করবে, এ বিষয়ে পরিষ্কার হতে হবে। আমরা দেখতে পাই, তারা ঋণগ্রহীতাদের প্রতিনিধিত্ব করে।
ব্যাংক নিয়ে লেখালেখির ক্ষেত্রে কিছু শব্দ না ব্যবহার করা ভালো। যেমন বলা হয়, মালিকপক্ষ। যদিও তাঁরা পরিচালক হিসেবে ব্যাংকে প্রতিনিধিত্ব করেন। আবার বলা হয়, সরকারি বা বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক। তাহলে কি আমরা বলব যে সোনালী ব্যাংকের আমানতকারীরা সরকারি আমানতকারী আর সিটি ব্যাংকের আমানতকারীরা বেসরকারি? বরং সরকারি খাতে পরিচালিত ব্যাংক বা বেসরকারি খাতে পরিচালিত ব্যাংক—এভাবে শব্দগুলো ব্যবহার করা সঠিক হবে। এগুলোও সুশাসনের অংশ।
ব্যাংক খাতের সংস্কারের কথা বললে পুরো আর্থিক খাতের মানচিত্রকে সামনে রাখতে হবে। শুধু ব্যাংক সংস্কার করতে চাইলে, তা টেকসই হবে না। ব্যাংকগুলোর স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের উৎস কী, তা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে নেওয়া নীতিগুলো ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে যাওয়া উচিত। তবে আমরা দেখেছি, এসব নীতি ব্যাংকের পক্ষে গেছে।
আবার সরকারি ব্যাংকগুলোর কথা বিবেচনা করা যায়। এগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংক নয়, বিশেষায়িত ব্যাংক। তারা সরকারের অনেক ধরনের পলিসি বাস্তবায়ন করে থাকে। এখন যদি তাদের বাণিজ্যিক ব্যাংক বলেন, তাহলে নীতিমালার দিক থেকে তাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতায় আনতে হবে এবং বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনার সুযোগ দিতে হবে। তবে বাস্তবতা হলো তাদের প্রতি বড় ধরনের বৈষম্য করা হয়।
খেলাপি ঋণ বা এনপিএলের বিষয়ে বলব, যেটা শরীরের অঙ্গ, সেটা খারাপ না। পৃথিবীর এমন কোনো ব্যাংক নেই, যেখানে এনপিএল নেই। তবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি খারাপ। যারা অনিচ্ছাকৃত খেলাপি, তাদের সহায়তা করা প্রয়োজন আর যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি, তাদের শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। এর আগে ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে।
খেলাপি ঋণের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। অথচ এটি চোখের আড়ালে থেকে যায়। কারণ, এ ধরনের বাণিজ্যের সব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক সংগ্রহ করে না। দেশের তৈরি পোশাক খাতের উন্নয়নে ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র (এলসি) বড় অবদান রেখেছে। তবে এটিও ঠিক, আজকের পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যতটা জালিয়াতি হয়, তার ৭০-৮০ শতাংশ হয় ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির মাধ্যমে। অর্থ পাচারও হয়। সুতরাং, ব্যাক-টু-ব্যাক কখনো নীতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না। ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি ছাড়া গার্মেন্টস চলবে না—আমরা সে অবস্থায় নিয়ে গেছি।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জায়গায় বলব, টেকসই ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) বড় অবদান রয়েছে। এসএমইদের সেবা দেওয়ার জন্য ব্যাংকে পৃথক ডেস্ক তৈরি করেছি; কিন্তু তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সহায়তা করার জন্য তেমন কোনো সুবিধা নেই। এসএমইদের জন্য ক্লাস্টারভিত্তিক অর্থায়ন কাজও ঠিকভাবে করা হয় না।
শাহ মো. আহসান হাবীব
অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)