ব্যাংক চলছে ধারে, তবু অ্যাননটেক্সে উদার জনতা
তারল্যসংকটে পড়ে প্রতিদিন ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ধার করতে হচ্ছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংককে। গত এক বছরে বেড়েছে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণও। এমন কঠিন সময়ে ব্যাংকটির অন্যতম বড় গ্রাহক অ্যাননটেক্সের ঋণের ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে দিয়েছে জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
ব্যাংকটির পর্ষদের শর্ত হলো, ৩১ মার্চ পর্যন্ত ঋণটি নিয়মিত থাকবে। এরপর জুন মাসের মধ্যে অ্যাননটেক্সকে ৪ হাজার ৮২০ কোটি টাকা শোধ করতে হবে। শোধ করতে না পারলে অ্যাননটেক্সের ঋণ বিরূপ মানে খেলাপি অবস্থায় চিহ্নিত করবে জনতা ব্যাংক। গত বছরের ডিসেম্বের এই সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংকটি।
এর আগে ন্যাশনাল ব্যাংক চট্টগ্রামের একটি গ্রুপের ২ হাজার ১৯৯ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে। এরপর থেকে বেসরকারি খাতের ব্যাংকটির তারল্যসংকট আরও প্রকট হয়। ওই একই পথ অনুসরণ করছে জনতা ব্যাংক।
অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণ ব্যাংক খাতে বেশ আলোচিত বিষয়। ২০২০ সালে জাতীয় সংসদে পেশ করা শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকায় ১ম স্থানে ছিল গ্রুপটি। বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ১৮টি প্রতিষ্ঠান খুলে জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নেন এসবের প্রকৃত মালিক মো. ইউনুছ ওরফে বাদল একাই। সুদসহ পরে যা বেড়ে হয় ৮ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, অ্যাননটেক্স গ্রুপকে সীমার বেশি ঋণ নেওয়ার এই সুযোগ করে দেন জনতা ব্যাংকেরই কিছু কর্মকর্তা, যাঁদের অনেকে এখন ব্যাংকটির শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছেন। কেউ কেউ আবার চাকরি শেষে অবসরেও গেছেন। তবে অ্যাননটেক্সের ঋণ নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও এর সঙ্গে জড়িত কারও শাস্তি হয়নি, বরং কেউ কেউ পদোন্নতি পেয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকও (এমডি) হয়েছেন।
হঠাৎ সুদ মওকুফ কেন
জনতা ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, সুদ মওকুফের মাধ্যমে রাষ্ট্রমালিকানাধীন এই ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্সের ঋণের অস্তিত্ব মুছে ফেলার একটি প্রক্রিয়া চলছে। এর ফলে যাঁরা গ্রুপটিকে সীমার বেশি ঋণ দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা আড়ালে চলে যাবেন। আর যাঁরা এর মাধ্যমে সুবিধা নিয়েছিলেন, তাঁরা বহাল তবিয়তে থাকবেন। অনিয়ম-দুর্নীতি সবই চাপা পড়ে যাবে।
অন্যদিকে ব্যাংকটি আমানতকারীদের অর্থে গ্রুপটিকে অর্থায়ন করেছিল। সুতরাং এসব আমানতকারীকে ঠিকই সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে জনতা ব্যাংককে। কিন্তু এখন সুদ মওকুফের মাধ্যমে ব্যাংকটির তারল্য ব্যবস্থাপনা আরও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
হল-মার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির পর অ্যাননটেক্সকে দেওয়া জনতা ব্যাংকের ঋণই ছিল ব্যাংক খাতে আলোচিত ঋণ কেলেঙ্কারি। এটি একক ঋণের বৃহত্তম কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিতিও পেয়েছিল।
জনতা ব্যাংকের একাধিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে জানা যায়, অ্যাননটেক্সের কোম্পানিগুলোর নামে বিভিন্ন সময়ে কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হলেও টাকা পরিশোধ করা হয়নি। তখন ওই সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ব্যাংক নিজেই বাধ্য হয়ে বিদেশি রপ্তানিকারক কোম্পানিকে অর্থ পরিশোধ করে দিয়েছে। এরপরও গ্রাহক ওই অর্থ পরিশোধ করেনি। এভাবে নেওয়া ঋণসুবিধার (নন-ফান্ডেড) সব অর্থই সরাসরি ঋণে (ফান্ডেড) পরিণত হয়েছে। আবার দৈনন্দিন ব্যবসা পরিচালনার জন্য নেওয়া চলতি মূলধনও (সিসি ঋণ) ফেরত দেওয়া হয়নি। এরপরও ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠানটিকে অর্থায়ন করেছে।
কী প্রক্রিয়ায় হচ্ছে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অ্যাননটেক্সের বিপুল পরিমাণ সুদ মওকুফের ধারণাটি এসেছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের অনেকটা একই রকম উদ্যোগের ধারণা থেকে। ন্যাশনাল ব্যাংক ২০২১ সালে চট্টগ্রামের একটি গ্রুপের সাত গ্রাহকের ২ হাজার ১৯৯ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে দেয়। এরপর ওই সাত প্রতিষ্ঠান ৪ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা পরিশোধ করে ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে বের হয়ে যায়। বিভিন্ন শর্ত দিয়ে এক দিনেই সাত গ্রাহকের সুদ মওকুফ করার বিষয়ে তখন অনাপত্তি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
যে সুদ মওকুফ করা হয়েছিল, তা আরোপিত হয়েছিল ১০ বছরে। ন্যাশনাল ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার গুলশান শাখা ২০০৩ সাল থেকে বিভিন্ন সময় এই সাত প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, চট্টগ্রামের যে গ্রুপের সুদ মওকুফ করেছিল ন্যাশনাল ব্যাংক, সেই গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করে অ্যাননটেক্স গ্রুপ। কয়েকটি ব্যাংকের মালিকানা রয়েছে ওই গ্রুপের হাতে। অ্যাননটেক্স গ্রুপের সব কোম্পানির মালিকানা নেওয়ার বিনিময়ে সুদ মওকুফের মাধ্যমে ঋণ শোধ করার আশ্বাস দেয় গ্রুপটি। জনতা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এতে সায় দেন। এরপর সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
তবে ইসলামী ব্যাংকের পর শরিয়াহভিত্তিক আরও কয়েকটি ব্যাংক তারল্যসংকটে পড়ায় সেই উদ্যোগ আপাতত থমকে যায় বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে। ফলে অ্যাননটেক্সের সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
চট্টগ্রামের গ্রুপটির একজন কর্মকর্তা জানান, ইসলামী ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অ্যাননটেক্স গ্রুপের কোম্পানিগুলো কেনার সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে পারে।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য অ্যাননটেক্স গ্রুপের কর্ণধার মো. ইউনুছের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
যা বলছেন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান
অ্যাননটেক্স গ্রুপের ১৮টি প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রকল্প ঋণ, মেয়াদি ঋণ ও অন্যান্য সৃষ্ট দায়ের পরিমাণ ৮ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬টি প্রতিষ্ঠানের ঋণ জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের জনতা ভবন করপোরেট শাখায় ও দুটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ স্থানীয় শাখায়। তবে ব্যাংকটিতে অ্যাননটেক্সের গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ২২টি।
অ্যাননটেক্সের প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সিমি নিট টেক্স, সুপ্রভ কম্পোজিট, এফকে নিট, সিমরান কম্পোজিট, জারা নিট টেক্স, গ্যাট নিট টেক্স, জেওয়াইবি নিট টেক্স, লামিসা স্পিনিং, জ্যাকার্ড নিট টেক্স, আলভী নিট টেক্স, এম নূর সোয়েটার্স, সুপ্রভ স্পিনিং, জারা লেবেল অ্যান্ড প্যাকেজিং, সুপ্রভ মিলাঞ্জ স্পিনিং, শাইনিং নিট টেক্স, জারা ডেনিম, সুপ্রভ রোটর স্পিনিং, গ্যালাক্সি সোয়েটারসহ আরও কয়েকটি।
গ্রুপটির কাছে পাওনা ঋণের মধ্যে ৪ হাজার ৮২০ কোটি টাকা আগামী জুন মাসের ভেতরে পরিশোধ করতে হবে। এই শর্ত পূরণ হলেই কেবল ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি সুদ মওকুফ পাবে অ্যাননটেক্স।
জনতা ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুছ ছালাম আজাদ যখন ভবন শাখার ব্যবস্থাপক, তখনই এসব ঋণ দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে তিনি ব্যাংকটির এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এখন ইতালি সফরে রয়েছেন। ফলে তাঁর বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলেন। তিনি প্রথম আলোকে জানান, ‘এটা দীর্ঘদিনের খেলাপি ঋণ। এর ফলে ব্যাংকের স্বাস্থ্য খারাপ দেখাচ্ছে। সে জন্য যখন আসল শোধ করে চলে যাওয়ার প্রস্তাব এসেছে, পর্ষদ নিয়ম মেনে তার অনুমোদন দিয়েছে।’
এস এম মাহফুজুর রহমান আরও বলেন, ‘ওই গ্রাহক কীভাবে ঋণ শোধ করবে, কার কাছে বিক্রি করবে, সেই বিষয়টি পর্ষদে আসেনি। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে জানার সুযোগ হয়নি। নির্ধারিত সময়ে শোধ করতে না পারলে সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যাবে। তবে তখন আবারও ঋণ শোধ করতে চাইলে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত দেবে পর্ষদ।’
জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘ব্যাংকের যে তহবিল খরচ, তা আদায় সাপেক্ষে সুদ মওকুফ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগেও অনেক গ্রাহক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম মেনে এই সুযোগ নিয়েছে। ভবিষ্যতে কেউ আসলে তারাও পাবে।’
তিন শাখায় কেন্দ্রীভূত ৬০% ঋণ
জনতা ব্যাংকের তিন শাখায় কেন্দ্রীভূত আছে ব্যাংকটির বেশির ভাগ ঋণ। এই তিন শাখার কিছু বড় গ্রাহকই ব্যাংকটির বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অ্যাননটেক্সের ঋণও ছিল এই তিন শাখার দুটিতে।
ব্যাংকের শাখা তিনটি হলো ঢাকার জনতা ভবন করপোরেট শাখা ও লোকাল অফিস এবং চট্টগ্রামের সাধারণ বীমা ভবন করপোরেট শাখা। ব্যাংকটির ৮৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি এই তিন শাখার অধীনে। আর প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত গ্রাহকেরাও মূলত এই তিন শাখার গ্রাহক।
২০১৫ সালেও জনতা ব্যাংক ছিল রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ভালো অবস্থানে। আগে ব্যাংকটির গ্রাহক ছিল দেশের প্রথম শ্রেণির রপ্তানিকারক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। সময়ের ব্যবধানে এখন দেশের শীর্ষ খেলাপি ও প্রভাবশালীরা ব্যাংকটির বড় গ্রাহক। ফলে খেলাপি ঋণের হারও দাঁড়িয়েছে ১৭ শতাংশের বেশি। অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট বড় ঋণখেলাপি গ্রাহক। আগে ব্যাংকটি অন্য ব্যাংককে টাকা ধার দিত, এখন প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্য ব্যাংক থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ধার করে চলতে হচ্ছে।
আর্থিক পরিস্থিতি
২০২১ সালে জনতা ব্যাংকের আমানত ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, ২০২২ সাল শেষে যা হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। আমানত সামান্য কমলেও ব্যাংকটির ঋণ বেশ বেড়েছে। ২০২১ সালে ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৯ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা, যা গত বছরে বেড়ে হয়েছে ৮৫ হাজার ২০৬ কোটি টাকা।
তবে বিনিয়োগ কমেছে। ২০২১ সালে ব্যাংকটি ট্রেজারি বিল, বন্ড, অন্যান্য ব্যাংকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছিল ১৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা, গত বছর যা কমে হয়েছে ১২ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা।
এ সময় খেলাপি ঋণ ১২ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। আর মূলধন-ঘাটতি ৭২৩ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলেও সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি যৌক্তিক কারণে হয়, তাহলে সুদ মওকুফ হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘদিন আলোচনায় থাকা এই প্রতিষ্ঠানকে যারা নিয়মবহির্ভূত অর্থায়ন করেছে, তাদের ধরতে হবে। এমনকি অবসরে চলে গেলেও তাদের জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘জনগণের আমানত নিয়ে যারা নয়-ছয় করবে, তাদের ছাড় দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না। এতে গ্রাহকের আস্থা কমে যাবে।’