ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য গোপন, এনআরবিসিকে জরিমানা

এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংক

একটি হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য গোপন করায় বেসরকারি খাতের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংককে (এনআরবিসি) ৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচালক আবু বকর চৌধুরীর পরিচয়সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিভ্রান্ত করেছে এবং প্রবাসীদের শেয়ার নিয়ে ভুল তথ্য দিয়েছে। সে জন্য প্রবাসীদের উদ্যোগে গঠিত এনআরবিসি ও এর সব পরিচালককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-৩ গত ২০ অক্টোবর এনআরবিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) এক চিঠিতে এসব বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। এতে ব্যাংকটিতে প্রবাসীদের শেয়ার ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলেছে।

এ নিয়ে এনআরবিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্বে) রবিউল ইসলামকে ফোন করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য গোপন

জানা গেছে, এনআরবিসি ব্যাংকের চট্টগ্রামের ও আর নিজাম রোড শাখার গ্রাহক মো. রেজাউল বশির চৌধুরীর সঞ্চয়ী হিসাবে অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক লেনদেন চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বিএফআইইউকে জানানো হয়নি। এ বিষয়ে যথাসময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট না করার কারণে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় ব্যাংকটিকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

— প্রবাসী উদ্যোক্তাদের শেয়ার ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশ। — সব পরিচালক, এমডি, কোম্পানি সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠিতে বলেছে, সাত দিনের মধ্যে জরিমানার অর্থ পরিশোধ না করলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত তাদের চলতি হিসাব সমন্বয় করে আদায় করা হবে। পাশাপাশি ২০২১ সালের ১৮ মে থেকে ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ওই শাখায় দায়িত্ব পালনকারী ব্যবস্থাপক, শাখা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তা ও ব্যাংকের প্রধান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তাকে এই লেনদেনের সঙ্গে জড়িত সব কর্মকর্তা–কর্মচারীর দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে তাঁদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে।

পরিচালকের পরিচয়পত্রের তথ্যও গোপন

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক (এনআরবিসি) কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানায়, তাদের উদ্যোক্তা পরিচালক আবু বকর চৌধুরীর জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্যাংকে সংরক্ষিত নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে বেরিয়ে আসে ব্যাংকটির চট্টগ্রামের ও আর নিজাম রোড শাখায় আবু বকর চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বায়েজিদ স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজের নথিতে তাঁর এনআইডির কপি সংরক্ষিত রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের হিসাব খোলার ফরমে মালিকের ব্যক্তিগত তথ্যের অংশে এনআইডি নম্বরের উল্লেখ রয়েছে। এর মানে আবু বকর চৌধুরী উদ্যোক্তা শেয়ার কেনার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করেছে ব্যাংকটি।

বাংলাদেশ ব্যাংককে মিথ্যা তথ্য বা বিবৃতি প্রদানের কারণে ব্যাংকের পরিচালক আবু বকর চৌধুরীসহ সব পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কোম্পানি সচিবসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কেন ব্যাংক কোম্পানি আইনের ধারা ১০৯(২)–এর আওতায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। প্রত্যেককে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১০৯(৯) ধারা অনুযায়ী ১৪ দিনের মধ্যে পৃথকভাবে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। এ ধারার আওতায় সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা জরিমানা ও সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, চিঠি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে এনআরবিসি ব্যাংকের সব প্রবাসী উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারদের আইনানুগ আবাসিক মর্যাদা পুনর্যাচাই করে দলিলাদিসহ প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।

শেয়ারের তথ্যও গোপন

বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো তথ্যে এনআরবিসি ব্যাংক জানায়, ৬৮ শতাংশ শেয়ার উদ্যোক্তা পরিচালকদের এবং ৩২ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিদর্শনে গিয়ে এই তথ্যের সত্যতা পায়নি। তারা ব্যাংকটিকে চিঠি দেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে প্রবাসী উদ্যোক্তাদের শেয়ার ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছে। এতে ব্যর্থ হলে ব্যাংক কোম্পানি আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনার লক্ষ্যে প্রদত্ত লাইসেন্সের শর্ত পালনে ব্যর্থতার কারণে অদক্ষতা ও দায়িত্বে অবহেলার দায়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক মাসের মধ্যে যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে তার প্রমাণ হিসেবে দলিলপত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাঠাতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটির বিভিন্ন অনিয়ম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কিন্তু শীর্ষ পর্যায়ের বাধার কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এখন পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের অনিয়ম ও হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে স্বতন্ত্র পর্ষদকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।