ডলারের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত আমদানিকারকেরা ঋণ পরিশোধে ৮ বছর সময় পাবেন

মার্কিন ডলারছবি: সংগৃহীত

মার্কিন ডলারের দাম বাড়ার কারণে যেসব আমদানিনির্ভর শিল্প খাত ক্ষতির মুখে পড়েছে, তারা ঋণ পরিশোধে আট বছর পর্যন্ত সময় পাবে। এসব ঋণ আলাদাভাবে হিসাব করে এক বছরের বিরতিসহ প্রতি মাসে বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে পরিশোধ করা যাবে। যেসব আমদানিকারক বিলম্বে ঋণ পরিশোধের শর্তে পণ্য আমদানি করেছিলেন এবং ক্ষতির শিকার হয়েছেন, শুধু তাঁরাই এ সুযোগ পাবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল বুধবার এক প্রজ্ঞাপনে ব্যাংকগুলোকে এ নির্দেশনা দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, কোভিড-১৯–এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাসহ নানা কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার মূল্যমান উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় স্থানীয় উৎপাদনমুখী শিল্পগুলো কাঁচামাল আমদানিকালে বিনিময় হারজনিত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতা হ্রাসসহ ফোর্সড ঋণ সৃষ্টি হচ্ছে এবং চলতি মূলধনের ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আমদানিনির্ভর শিল্পসহ স্টিল খাত, সিমেন্ট খাত ও স্থানীয় যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পণ্যের বিক্রয় মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত, সেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখার মাধ্যমে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানির গতিধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে নতুন নির্দেশনা প্রদান করা যাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনার ফলে খাদ্যপণ্য আমদানিকারকদের অনেকে এ সুবিধা পাবেন। কারণ, তেল, চিনিসহ নানা পণ্যের দাম সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানির জন্য ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত খোলা ঋণপত্রের ক্ষেত্রে বিনিময় হারজনিত ক্ষতির মোট পরিমাণ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক নির্ধারণ করবে। অপ্রত্যাশিত বিনিময় হারজনিত ক্ষতির মোট পরিমাণ নির্ণয়ের পদ্ধতিও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতির সমপরিমাণ অর্থ গ্রাহকের ঋণঝুঁকি বিশ্লেষণ করে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে চলতি মূলধন ঋণসীমার বাইরে আলাদা একটি মেয়াদি ঋণ হিসাবে স্থানান্তর করা যাবে, যা সর্বোচ্চ এক বছরের বিরতিসহ সর্বোচ্চ আট বছর মেয়াদে সমকিস্তিতে (মাসিক বা ত্রৈমাসিক) পরিশোধযোগ্য হবে।

এতে আরও বলা হয়, এ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে একক গ্রাহক ঋণসীমা কোনোভাবেই অতিক্রম করা যাবে না। কোনো খেলাপি গ্রাহক প্রতিষ্ঠান এ সুবিধা পাবে না। এ সুবিধা নিতে চাইলে গ্রাহকদের আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে নিজ নিজ ব্যাংকে আবেদন করতে হবে। এ ছাড়া গ্রাহক বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের কারণে প্রকৃত অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কি না, তা ব্যাংক কর্তৃক নিশ্চিত হতে হবে এবং এ–সংক্রান্ত নথিপত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগের যাচাইয়ের জন্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।

সম্প্রতি ইস্পাত খাতের তিনটি সংগঠন বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ), বাংলাদেশ রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ স্টিল মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, ইস্পাতশিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের ৯০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। গত আড়াই বছরে মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে ১২০ থেকে ১২৫ টাকা হয়েছে। ফলে ইস্পাতশিল্পের চলতি মূলধন ৪০ শতাংশ কমে গেছে। মূলধনের ঘাটতির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের দায় পরিশোধ করতে পারছে না এবং খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলো চলতি মূলধনসীমাও কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে সংকটের মুখোমুখি হয়েছে এ খাত।

সমিতিগুলো জানায়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে বিশেষ সুবিধা প্রয়োজন। তাঁদের দাবি, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে এ খাতে বাড়তি ঋণের যে দায় তৈরি হয়েছে, তা নিয়মিত ব্যাংকঋণের বাইরে রেখে ১৬ বছরে কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেওয়া। যেখানে ঋণ পরিশোধের রেয়াতি সময় বা গ্রেস পিরিয়ড থাকবে দুই বছর। এরই মধ্যে পুনঃ তফসিল হওয়া ও বিলম্বিত ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও একই সুবিধা চেয়েছেন ইস্পাত খাতের ব্যবসায়ীরা। 

জানতে চাইলে ইস্পাতশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত ক্ষতি পোষাতে ৮ বছরের সুবিধা দিয়েছে। আমরা মনে করি এটি যথেষ্ট নয়। আমরা কমপক্ষে ১৫ বছরের জন্য এ সুবিধা দাবি করেছি; কারণ, এত কম সময়ে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। এ ছাড়া এ সুবিধা দেওয়া হয়েছে শুধু ২০২২ সালের ক্ষতির বিপরীতে। আমরা ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সময়ের জন্য এ সুবিধা চেয়েছিলাম। আশা করছি আমাদের দাবিগুলো পুনর্বিবেচনা করা হবে।’