সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা বদলের পেছনেও গোয়েন্দা সংস্থা, পর্ষদ ভাঙতে উদ্যোক্তাদের চিঠি

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়প্রথম আলো

মালিকানা বদলের শিকার হওয়া সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যাংকের কয়েকজন উদ্যোক্তা ও শেয়ারধারী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো এক চিঠিতে তাঁরা অভিযোগ করেছেন, ২০১৭ সালে একটি গোয়েন্দা সংস্থা অস্ত্রের মুখে ব্যাংকের তৎকালীন নেতৃত্বকে পদত্যাগে বাধ্য করে। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ শুধু টাকা পাচার, ব্যাংক লুটপাট ও তাদের নির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ব্যাংকটি দখল করেছে। গ্রাহকের স্বার্থ ও টাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের লক্ষ্য নয়।

এই চিঠিতে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক নতুন করে যে ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, তার সিংহভাগ নামে–বেনামে তুলে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ ও তাদের সহযোগীরা। সীমাহীন দুর্নীতির কারণে ব্যাংকটি দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। ফলে বর্তমানে গ্রাহক পর্যায়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, অনেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে আজ চিঠিটি পাঠান সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের তিনজন উদ্যোক্তা। তাঁরা হলেন সাবেক চেয়ারম্যান মেজর রেজাউল হক (অব.), নির্বাহী কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. আনিসুল হক এবং নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. আঙ্গুর রহমান।

২০১৭ সালে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। এখন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের জামাতা বেলাল আহমেদ। তবে ব্যাংকটি দখলের পর চেয়ারম্যান করা হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফকে।

ব্যাংকটি কীভাবে দখল হয়েছিল—জানতে চাইলে সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ব্যাংকের এমডি, ভাইস চেয়ারম্যান ও আমাকে ডেকে নিয়ে যায় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। সেখানে তাঁদের কার্যালয়ে আমাদের পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়। এরপর আমার সঙ্গে দেখা করেন সাইফুল আলম, তাঁর ভাই আবদুস সামাদ লাবু ও বেলাল আহমেদ। পরে সংস্থাটির মহাপরিচালক সাইফুল আবেদীন আমাকে জানান, ওপরের নির্দেশে এই মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। এর পর থেকে ব্যাংকটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নেওয়া হয়েছে। এ জন্য আমরা পর্ষদ দ্রুত পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো চিঠিতে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৪০৪তম সভা নির্ধারিত ছিল মতিঝিলের প্রধান কার্যালয়ে। সেদিন স্বৈরাচারী সরকারের একটি বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে এস আলম এবং তাঁদের সহযোগীরা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সচিবকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে উক্ত বাহিনীর কার্যালয়ে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। পরে পর্ষদের ওই সভা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের পরিবর্তে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থায় হোটেল ওয়েস্টিনে অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে পর্ষদের অন্য সদস্যদেরও জোরপূর্বক বাসা থেকে তুলে এনে প্রথমে গোয়েন্দা সংস্থা অফিসে, পরে তাদের তত্ত্বাবধানে হোটেল ওয়েস্টিনে হাজির করা হয়।’

চিঠিতে বলা হয়, এস আলম গ্রুপের সীমাহীন দুর্নীতি ও নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ায় ব্যাংকটি অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেও বিশেষ ব্যবস্থায় ব্যাংকের টাকা এস আলম গ্রুপ ও তার বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান নামে ও বেনামে উত্তোলন অব্যাহত রেখেছে, যা দ্রুত বন্ধ করা দরকার। না হলে গ্রাহকের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।

ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, ব্যাংকের গ্রাহকের আমানত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে পরিশোধ করার প্রক্রিয়া চলমান থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পরিচালিত চলতি হিসাবে ঘাটতি দিন দিন বাড়ছে। এ ছাড়া পটিয়ার লোকজনকে একচেটিয়া নিয়োগ দেওয়ায় ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

ব্যাংকটিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে পরিচালনা পর্ষদ দ্রুত ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি ‘এস আলমের আজ্ঞাবহ এমডি, ডিএমডিসহ সব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে অপসারণ’ করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের প্রতিনিধি হিসেবে প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন আনোয়ারুল আজিম আরিফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকে কোনো অনিয়ম হলে তা এমডি বলতে পারবেন। চেয়ারম্যান হিসেবে আমার কোনো দায় নেই। আমাকে এস আলম গ্রুপ থেকে দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছিল। অবসরে থাকায় আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম। এর বেশি কিছু আমি জানি না।’