টেলিভিশন চ্যানেলের সরঞ্জাম কেনার ঋণ এখন ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’
একে একে তিনটি কাগুজে কোম্পানি খুলে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ৭৬৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। এর মধ্যে নতুন এক প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে পুরোনো একটি ঋণ শোধ করা হয়েছে। কিছু টাকা গেছে ন্যাশনাল ব্যাংকের উদ্যোক্তা সিকদার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবেও। ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এসব ঋণ বের করা হয়, যা নেওয়া হয়েছে টেলিভিশনের সম্প্রচার সরঞ্জাম ও ভবন নির্মাণের নামে।
এখন এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির পাওনা দাঁড়িয়েছে মোট ৭৬৯ কোটি টাকা। খেলাপিও হয়ে পড়েছে এসব ঋণ। যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও গ্রাহকের সাড়া পাচ্ছে না ব্যাংক। সে কারণে গ্রাহককে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’ ঘোষণা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের নথিপত্র পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাজধানীর মালিবাগের শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়কের ৪২ নম্বর ভবনের ঠিকানা ব্যবহার করে এসব অর্থ তুলে নেওয়া হয়। ভবনটি দেশ টেলিভিশনের কার্যালয় হিসেবে পরিচিত। টেলিভিশনটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নাম ব্যবহার করে ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়। তবে ওই ঠিকানায় ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি ব্যাংক। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো প্রকৃতি অ্যাসোসিয়েটস, হাসান টেলিকম ও ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট। এর মধ্যে ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেটের কাছে পাওনা ৬৬৮ কোটি টাকা, যাকে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’ হিসেবে চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক।
নগদ অর্থের সংকটে থাকা প্রথম প্রজন্মের এই ব্যাংকের কর্মকর্তারা প্রতিনিয়তই বিভিন্ন শাখায় অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। এসব কর্মকর্তার অভিযোগ, টাকা নিয়ে ফেরত না দেওয়া কিছু গ্রাহকের কারণেই ব্যাংকটি এখন বিপাকে পড়েছে।
— ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেটকে, পাওনা ৬৬৮ কোটি টাকা।
— কোম্পানির একজন পরিচালক আরিফ হাসান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ উজ্জামান খান।
— হাসান টেলিকমের ঋণ শোধ করতে ব্যবহার করা হয়েছে ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেটের ঋণ।
— হাসান টেলিকমের চেয়ারম্যান আরিফ হাসান দেশ টেলিভিশন চ্যানেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
ন্যাশনাল ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে সিকদার গ্রুপ ও পরে কিছুদিন এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন উদ্যোক্তা পরিচালক ও ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু। তবে ব্যাংকটির তারল্যসংকট কাটেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিশ্চয়তার বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে সংকট কাটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে ন্যাশনাল ব্যাংক।
জানতে চাইলে আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে অনেকেই ফেরত দিচ্ছে না। অনেকের সঙ্গে যোগাযোগও করা যাচ্ছে না। এ জন্য তারল্যসংকট তৈরি হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের সভায় চারটি প্রতিষ্ঠানকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন তার নীতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে খেলাপিদের শাস্তি হবে। এতে অন্যরাও শিক্ষা পাবে।’
আবদুল আউয়াল মিন্টু আরও বলেন, ‘ব্যাংকের লেনদেন চলতি সপ্তাহে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এ জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
যেভাবে ছলচাতুরী
২০১৮ সালের ১ নভেম্বর হাসান টেলিকম ২৭৫ কোটি টাকা ঋণের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংকের মহাখালী শাখায় আবেদন করে। টেলিভিশনের সম্প্রচার সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য এই ঋণ চাওয়া হয়। একই বছরের ২৭ নভেম্বর ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ এই ঋণ অনুমোদন করে। এরপর ১০০ কোটি টাকা নগদ তুলে নেওয়া হয় নভেম্বর মাসেই। বাকি টাকা তোলা হয় পরের তিন মাসের মধ্যে। হাসান টেলিকমের চেয়ারম্যান আরিফ হাসান দেশ টেলিভিশন চ্যানেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালক আলমগীর জাহান একই চ্যানেলের কর্মকর্তা। আরিফ হাসান নিজে ও অন্যদের মাধ্যমে এসব টাকা উত্তোলন করেন।
ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে কেউ শাস্তির মুখে পড়লে অন্যরা শিক্ষা পাবে। দেশে ঋণখেলাপির কারণে কারও শাস্তি পাওয়ার কথা শোনা যায় না। এটা হলে সহজে কেউ খেলাপি হতে চাইবে না, যা ব্যাংক খাতের উন্নতির জন্য ভালো বার্তা দেবে।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংক ঋণ দিলেও অর্থ সেই কাজে ব্যবহার করা হয়নি। পরে প্রতিষ্ঠানটির ২২ কোটি টাকার সুদও মওকুফ করে দেয় ব্যাংকটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাসান টেলিকমকে দেওয়া ঋণের ৬৪ কোটি টাকা সরাসরি জমা হয় ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক পরিচালক রিক হক সিকদার, সিকদার গ্রুপের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা সৈয়দ কামরুল ইসলাম (মোহন) এবং সিকদার গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠান পাওয়ার প্যাক ও সিকদার রিয়েল এস্টেটের হিসাবে।
হাসান টেলিকমের ঋণ শোধ করতে ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি খুলে ৪৯০ কোটি টাকা ঋণ চেয়ে একই শাখায় আবেদন জমা দেয় চক্রটি। ঢাকার রায়েরবাজারে ১৬ তলা ভবন নির্মাণের জন্য এই ঋণ অনুমোদন করে ব্যাংকটি। ওই কোম্পানির একজন পরিচালক আরিফ হাসান, তবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ উজ্জামান খান। তাঁদেরও ঠিকানা রাজধানীর মালিবাগের শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়কের ৪২ নম্বর ভবন। এই ঋণের ৪৬২ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে ৩৬১ কোটি টাকা ব্যবহার করে হাসান টেলিকমের সুদসহ পুরো ঋণ পরিশোধ করা হয়। বাকি টাকা স্থানান্তর হয় আরিফ হাসান, জনৈক জোবায়ের, আদনানসহ বিভিন্ন ব্যক্তির হিসাবে।
নথিপত্রে দেখা গেছে, ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেটকে দেওয়া ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ শোধ হয়নি, অন্যদিকে ১৬তলা ভবনও নির্মিত হয়নি। ফলে এই ঋণ এখন সুদসহ বেড়ে হয়েছে ৬৬৮ কোটি টাকা। ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেটকে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহক’ হিসেবে চিহ্নিত করার অনুমোদন দিয়েছে। পর্ষদের এই সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
এ ছাড়া ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট প্রকৃতি অ্যাসোসিয়েটস নামে ব্যাংকের মহাখালী শাখায় একটি হিসাব খুলে ৬০ কোটি টাকা ঋণ চেয়ে আবেদন করে চক্রটি। এই কোম্পানির কর্ণধার মোহাম্মদ শরীফ-উজ্জামান দেশ টেলিভিশনের কর্মচারী বলে ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গাজী টেলিভিশন, মাছরাঙা টেলিভিশন, এনটিভি ও বাংলাভিশনে সম্প্রচার সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য এই ঋণ চাওয়া হয়। ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর এই ঋণ অনুমোদন করা হয় এবং একই দিনে তা তুলে নেওয়া হয়। এরপর ৩ অক্টোবর আরও ২০ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করে কোম্পানিটি। এক সপ্তাহের মধ্যে ঋণ অনুমোদিত হওয়ার পর ১০ অক্টোবর তা বিতরণ করা হয়। তবে টাকা ফেরত দেননি গ্রাহক। ফলে এখন মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০১ কোটি টাকায়। ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোহাম্মদ শরীফ-উজ্জামানের নামে ঋণ নেওয়া হলেও এর প্রকৃত সুবিধাভোগী ছিলেন আরিফ হাসান।
বিভিন্ন অভিযোগে আরিফ হাসান সম্প্রতি পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। বক্তব্য জানার জন্য কোম্পানিগুলোর দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে অন্যদেরও পাওয়া যায়নি।
ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শাস্তি কী
বাংলাদেশ ব্যাংক গত মার্চে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণগ্রহীতা শনাক্তকরণ ও চূড়ান্তকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে গৃহীতব্য ব্যবস্থা’ শীর্ষক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করলে এবং জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে কেউ ঋণ নিলে তা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে। এ ছাড়া যে উদ্দেশ্যে ঋণ নেওয়া হয়েছে, তার বাইরে অন্য কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহার করলেও তা চিহ্নিত হবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে। এমন খেলাপিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করবে ব্যাংক।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোনো ব্যাংক এই প্রজ্ঞাপনের শর্ত লঙ্ঘন করলে তাকে কমপক্ষে ৫০ লাখ ও সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হবে। আর শর্ত লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে প্রতিদিন এক লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।
ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা এবং কোম্পানি নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা দিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের (আরজেএসসি) কাছে চিঠি দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাওয়ার যোগ্য হবেন না। গাড়ি, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যাদি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছেও তালিকা পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিয়ম না মেনে ঋণ দেওয়ার কারণে ব্যাংকটি আজ সংকটে পড়েছে। এখন ব্যাংকটি কোনো গ্রাহকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইলে এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা করা উচিত হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে কেউ শাস্তির মুখে পড়লে অন্যরা শিক্ষা পাবে। দেশে ঋণখেলাপির কারণে কারও শাস্তি পাওয়ার কথা শোনা যায় না। এটা হলে সহজে কেউ খেলাপি হতে চাইবে না, যা ব্যাংক খাতের উন্নতির জন্য ভালো বার্তা দেবে।’