বেসিক ব্যাংক দুর্নীতির সমপরিমাণ লোকসান ১০ বছরে
গত ১০ বছরে বেসিক ব্যাংক লোকসান দিয়েছে ৪,২৩০ কোটি টাকা। অনিয়মও হয়েছিল সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার।
সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আবদুল হাই বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। তবে তিনি ব্যাংকটিকে এমন পরিস্থিতিতে রেখে গেছেন যে এটি কোনোভাবেই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। এর নিয়মিত কার্যক্রম চালানোই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
অথচ একসময় রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ভালো অবস্থানে ছিল বেসিক ব্যাংক। শিল্প গ্রুপগুলো এই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করত। তখন ব্যাংকটি ভালো মুনাফা করত। উচ্চ বেতনে কর্মী নিয়োগ দিত। সে সময় পদাধিকারবলে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব।
তবে ২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আবদুল হাইকে চেয়ারম্যান বানিয়ে বেসিক ব্যাংকের নতুন পর্ষদ গঠন করে সরকার। এরপরই ভেঙে পড়ে ব্যাংকটির আর্থিক ব্যবস্থাপনা।
তাঁর পাঁচ বছরে (২০০৯-১৪) নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ হয় বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। ফলে ২০১৩-২০২২ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির লোকসান হয় ৪ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটি গত ১০ বছরে শেখ আবদুল হাইয়ের সময়ে সংঘটিত দুর্নীতির প্রায় সমপরিমাণ অর্থ লোকসান দিয়েছে।
উচ্চ আমানতের কারণে ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি ঠিক করা কঠিন হয়ে পড়েছে।আনিসুর রহমান, বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ব্যাংকটির সবচেয়ে বেশি লোকসান হয়েছে ২০১৬ সালে। সে বছর লোকসানের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২২ সালে লোকসান হয় ১৩০ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংক ২০১১ সালে ৯৭ কোটি ও ২০১২ সালে ২ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। এর আগের বছরগুলোতে গড়ে ৫০ কোটি টাকা মুনাফা করে আসছিল ব্যাংকটি।
শেখ আবদুল হাই বেসিক ব্যাংক ছেড়ে যাওয়ার ৯ বছর পার হলেও এখনো ব্যাংকটি আর্থিক সংকটে ধুঁকছে। কারণ, তাঁর সময়ে উচ্চ সুদে আমানত এনে কাগুজে কোম্পানির হাতে টাকা তুলে দেওয়া হয়, যা এখন ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংকটি। অন্যদিকে আমানতের বিপরীতে ঠিকই সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন প্রতিবেদনে ব্যাংকটির ঋণের টাকা লোপাটে শেখ আবদুল হাইয়ের সংশ্লিষ্টতা উঠে এলেও তাঁকে সম্মানের সঙ্গে পদত্যাগ করার সুযোগ করে দিয়েছিল সরকার। পরের আট বছর আত্মসাৎ করা অর্থে বাড়ি ও জাহাজ কিনে আরাম-আয়েশেই জীবন কাটান তিনি। অবশেষে তাঁকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আসামি করেছে। আবদুল হাইসহ ১৪৫ জনের বিরুদ্ধে দুদক অভিযোগপত্র দিয়েছে ৫৯টি। এর মধ্যে ৫৮টিতেই শেখ আবদুল হাই আসামি।
তবে তাঁর দুই মেয়াদের পর্ষদে যাঁরা পরিচালক ছিলেন, তাঁদের কাউকেই আসামি করেনি দুদক। অভিযোগপত্র দেওয়ার প্রস্তাব গত সোমবার অনুমোদন করেছে দুদক। এখন এগুলো আদালতে উপস্থাপন করা হবে। দুদক কার্যালয়ে সোমবার অনুষ্ঠিত এক ব্রিফিংয়ে শেখ আবদুল হাইকে আসামি করার বিষয়টি অবহিত করেন সংস্থাটির সচিব মো. মাহবুব হোসেন।
ঋণের ৫৮% খেলাপি
জানা গেছে, গত মার্চে ব্যাংকটির ১২ হাজার ৮০৬ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৫৮ শতাংশ অর্থাৎ ৭ হাজার ৪২৫ কোটি টাকাই খেলাপি ছিল। নিরাপত্তা সঞ্চিতি ও মূলধনঘাটতিসহ কোনো আর্থিক সূচকই ঠিক নেই ব্যাংকটিতে।
তবে খেলাপি ঋণ ও অবলোপনের বিপরীতে ২০২২ সালে ব্যাংকটি ৫৫৬ কোটি টাকা আদায় করেছে। ২০২১ সালে আদায় হয়েছিল ১৯৯ কোটি টাকা। তবে আদায় বাড়লেও ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ কমেনি।
বেসিক ব্যাংকে ২০২২ সালে পরিচালন লোকসান হয়েছে ১০৯ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৩৮৬ কোটি টাকা। পরিচালন লোকসান কমার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে নন-ফান্ডেড আয় ও কম সুদের আমানত বৃদ্ধি। গত বছর ব্যাংকটির কম খরচের আমানত ২৩৬ কোটি টাকা বেড়ে ৩ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা হয়েছে। আর সুদ ছাড়া অন্যান্য নন-ফান্ডেড আয় ৩১১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৩৭৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
শীর্ষ খেলাপি যারা
জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির ১২ হাজার ৮০৬ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৪ হাজার ৩৯০ কোটি টাকাই রয়েছে ২৫ গ্রাহকের কাছে। এর মধ্যে শুধু ম্যাক্স সোয়েটার, এবি গ্রুপ ও এসপিডিএসপির ঋণ নিয়মিত আছে। বাকি সবার ঋণই খেলাপি হয়ে পড়েছে।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, শীর্ষ খেলাপি গ্রাহকেরা হলো আমাদের বাড়ি, নিউ ঢাকা সিটি ডেভেলপমেন্ট, এমারেল্ড অটো ব্রিকস, আলী গ্রুপ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, নীলসাগর অ্যাগ্রো অ্যান্ড এলাইড, ফিয়াজ গ্রুপ, অ্যারিস্ট্রোক্র্যাট গ্রুপ, মিমকো কার্বন লিমিটেড, ভাসাবী ফ্যাশন, ওয়েলটেক্স গ্রুপ, রাইজিং গ্রুপ, ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপিং, বাসার গ্রুপ, জেইল ওয়ারস, ম্যাপ অ্যান্ড মুলার গ্রুপ, ওয়েল ওয়েল, রিজেন্ট ওয়েভিং, আইজি নেভিগেশন, বে নেভিগেশন, এমারেল্ড অয়েল অ্যান্ড এলাইড, প্রফিউশন টেক্সটাইল লিমিটেড।
বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুর রহমান এখন দেশের বাইরে আছেন, তাই তাঁর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সম্প্রতি তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, উচ্চ আমানতের কারণে ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি ঠিক করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যাংকিং ব্যবসা চালাতে হলে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ—দুটো চলমান রাখতে হবে। সরকারি উদ্যোগে কম সুদে আমানত পেলে ব্যাংকটিকে আগের অবস্থানে নেওয়া যেত।