ঘরে রাখা ডলার ফিরছে ব্যাংকে

এই হিসাবের ডলার কোনো বাছবিচার ছাড়াই দেশে ও বিদেশে গিয়ে খরচ করা যায়। প্রতিবার বিদেশে নগদ ৫ হাজার ডলার নেওয়া যায়।

মার্কিন ডলাররয়টার্স ফাইল ছবি

ঘরে রাখা ডলার ও অন্যান্য বিদেশি মুদ্রা আবার ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে। কারণ, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আরএফসিডি হিসাবে জমা দেওয়া ডলারের ওপর ৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে শুরু করেছে। পাশাপাশি এই হিসাবের ডলার কোনো বাছবিচার ছাড়াই দেশে ও বিদেশে গিয়ে খরচ করা যাচ্ছে। প্রতিবার বিদেশ ভ্রমণের সময় এই হিসাব থেকে নগদ ৫ হাজার মার্কিন ডলার নেওয়া যায়।

কোনো কোনো ব্যাংক এখন মানুষের ঘরে রাখা ডলার পেতে নানা সুবিধা দিচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর কাছে নগদ ডলারের মজুত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ২০ লাখ, যা এক মাস আগে ছিল ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অবশ্য ডলার–সংকটের আগে ব্যাংকগুলোতে গড়ে নগদ ৫ কোটি ডলার মজুত থাকত। এদিকে ব্যাংকে নগদ ডলারের মজুত বাড়লেও খোলাবাজারে এর প্রভাব পড়েনি। এখনো খোলাবাজারে প্রতি ডলার ১২০ টাকার ওপরে কেনাবেচা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের ৩ ডিসেম্বর থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে মানুষের ঘরে রাখা ডলার ব্যাংকে ফেরাতে  আবাসিক বৈদেশিক মুদ্রা আমানত বা রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট (আরএফসিডি) হিসাবের ওপর সুদসহ বাড়তি সুবিধা দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। এরপরই দি সিটিসহ কিছু ব্যাংক বাড়তি উদ্যোগ নিয়ে এই হিসাব খুলতে শুরু করে।

ব্যাংকে মানুষের ডলার জমা রাখার পরিমাণ বাড়ছে। যাঁরা বৈধ টাকায় ডলার কিনে বাসায় রেখেছিলেন, তাঁদের ডলারই ব্যাংকে ফিরে আসছে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, এমডি, এমটিবি

বর্তমানে নগদ ডলারের বড় অংশ মজুত আছে ইস্টার্ণ, দি সিটি, ব্র্যাক, ডাচ্-বাংলা, প্রাইম, পূবালী, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এইচএসবিসি, ইসলামীসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকে। মার্কিন ডলারের পাশাপাশি পাউন্ড, ইউরো, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, কানাডিয়ান ডলার, সিঙ্গাপুরি ডলারেও আরএফসিডি হিসাব খোলা যায়।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার ফলে ব্যাংকে মানুষের ডলার জমা রাখার পরিমাণ বাড়ছে। যাঁরা বৈধ টাকায় ডলার কিনে বাসায় রেখেছিলেন, তাঁদের ডলারই ব্যাংকে ফিরে আসছে। কারণ, জমা ডলারের ওপর এখন সুদ মিলছে। তবে যাঁরা অবৈধ অর্থে ডলার কিনে রেখেছেন, সেই ডলার ব্যাংকে না–ও ফিরতে পারে। ব্যাংকে নগদ ডলারের সরবরাহ বাড়াতে আমরা আগামী মাস থেকে প্রচারণাসহ নানা উদ্যোগ নেব।’

আরও পড়ুন

কাদের জন্য আরএফসিডি হিসাব

বিদেশ থেকে এসেছেন ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে এমন যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিক ব্যাংকে গিয়ে আরএফসিডি হিসাব খুলতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কবে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, এটা মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হলো, বিদেশ গেছেন তার প্রমাণপত্র অর্থাৎ পাসপোর্ট ও ভিসার নথিপত্র ব্যাংকে জমা দিতে হবে। হিসাব খোলার জন্য আরও প্রয়োজন দুই কপি ছবি, নমিনি, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন)। এই হিসাবের বিপরীতে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কোনো চেক বই না দিয়ে ডেবিট কার্ড দেয়, যা থেকে খরচে কোনো অনুমোদন লাগে না।

কত ডলার জমা রাখা যাবে

একজন নাগরিক প্রতিবার বিদেশ ভ্রমণের জন্য ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত আরএফসিডি হিসাবে জমা রাখতে পারবেন। ফলে গত এক বছরে যদি কেউ ১০ বার বিদেশ ভ্রমণ করে থাকেন, তিনি চাইলে তাঁর হিসাবে কোনো নথিপত্র ছাড়াই এক লাখ ডলার জমা দিতে পারবেন। তবে প্রতিবার ভ্রমণের ক্ষেত্রে এর বেশি পরিমাণ ডলার জমা দিতে চাইলে তাঁকে বেশি ডলার দেশে আনার জন্য কাস্টমসের ঘোষণাপত্র জমা দিতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো এখন এই হিসাবের বিপরীতে ৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়, এই হিসাবে জমা অর্থের ওপর ব্যাংকগুলো বেঞ্চমার্ক রেটের সঙ্গে আরও অন্তত দেড় শতাংশ সুদ দেবে। সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর) এখন ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। সে অনুযায়ী আরএফসিডি হিসাবে সুদহার দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৮১ শতাংশ।

যেসব সুবিধা মিলছে

বর্তমানে দেশের প্রত্যেক নাগরিক এক বছরে বিদেশে গিয়ে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ডলার খরচ করতে পারেন। যাঁরা দেশে বসে ই-কমার্সে কেনাকাটা করেন তাঁরা একবারে ৩০০ ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য কিনতে পারেন না। তবে আরএফসিডি হিসাবের বিপরীতে নেওয়া কার্ড দিয়ে বিদেশে গিয়ে খরচের কোনো সীমা নেই। হিসাবের পুরো অর্থই খরচ করা যায়। পাশাপাশি এই কার্ড দিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খরচের জন্য বিভিন্ন ধরনের অনুমোদনেরও প্রয়োজন পড়ে না। প্রতিবার ভ্রমণের ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে নগদ ৫ হাজার ডলার নেওয়া যায়।

এ ধরনের গ্রাহকেরা চাইলে দেশে বসেই বা বিদেশ গিয়ে যেকোনো মূল্যের পণ্য কিনতে পারছেন। ব্যাংকগুলোকে হিসাবের বিপরীতে প্রতিটি কার্ডের সঙ্গে অতিরিক্ত দুটি কার্ড দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সন্তান বা ভাই-বোনসহ গ্রাহকের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিও সেই কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন। আবার তাঁদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসংক্রান্ত খরচও এসব কার্ড দিয়ে পরিশোধ করা যাবে। এতে গ্রাহক সহজেই পরিবারের সদস্যদের খরচের ধরন জানতে পারছেন। কারণ, প্রতিটি লেনদেনের পর গ্রাহক খুদে বার্তা পান।

বাড়তি সুবিধাগুলো

সিটি ব্যাংক এই কার্ডের মাধ্যমে মোবাইলের রোমিং বিল, বিদেশে ক্রেডিট কার্ডের খরচের বিল, সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণের মাশুল ও হোটেল বুকিং খরচ দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ব্যাংকটি থেকে আরএফসিডি হিসাবের বিপরীতে একটি ক্রেডিট কার্ড ও দুটি অতিরিক্ত ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে হিসাব খুললে কার্ডের মাশুল ও বার্ষিক খরচ মওকুফ করবে ব্যাংকটি। এ ছাড়া আরএফসিডি হিসাবে ২ হাজার ডলার থাকলে বিমানবন্দরে অ্যামেক্সের লাউঞ্জ সুবিধা ব্যবহারের সুযোগও দিচ্ছে সিটি ব্যাংক।

জানা গেছে, গত ১৫ দিনে সিটি ব্যাংকে ১৭৭টি আরএফসিডি হিসাব খোলা হয়েছে। এতে জমা পড়েছে ২ লাখ ৩৬ হাজার ডলার ও ৪ হাজার ইউরো। ব্যাংকটিতে আগে থেকে এমন হিসাব ছিল ৫ হাজার। এসব হিসাবে জমা ছিল ৯০ লাখ ডলার। অন্য ব্যাংকগুলোতেও বাড়ছে এই হিসাব ও নগদ ডলারের মজুত।

সিটি ব্যাংকের রিটেইল ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান অরুপ হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, একজন নাগরিক বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি খরচ করতে পারেন না। তবে আরএফসিডি হিসাব থেকে যে ডলার খরচ করা হবে, তা ওই সীমার মধ্যে পড়ছে না। ফলে দেশের নাগরিকদের বিদেশে খরচের দুয়ার অনেকটা খুলে গেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পর্যটনে যাঁদের বাড়তি ডলার প্রয়োজন পড়ে, তাঁরা সহজেই এই হিসাব থেকে খরচ করতে পারছেন। পাশাপাশি তাঁদের দেওয়া হচ্ছে আকর্ষণীয় সুদ, বিনা মাশুলে কার্ড ও বিমানবন্দরের লাউঞ্জ সুবিধা। ফলে যাঁরা বিদেশে যাওয়া-আসা করেন, তাঁদের জন্য এটা বড় পাওয়া।