এক ডজন বেসরকারি ব্যাংকে নতুন এমডি আসছে
বেসরকারি খাতের প্রায় এক ডজন ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে নতুন মুখ আসছে। এখন থেকে আগামী দুই বছরে এসব ব্যাংকের শীর্ষ পদে নতুন মুখ দেখা যাবে। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে এমডি পদে থাকা অনেক দক্ষ ব্যাংকারই বয়সের কারণে বিদায় নেবেন। এ তালিকায় আছেন ব্র্যাক, ডাচ্-বাংলা, এমটিবি, ইস্টার্ণ ও মিডল্যান্ড ব্যাংকের এমডি। আবার অনিয়মের কারণে ডুবতে থাকা ছয় ব্যাংকের এমডিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের ছুটি থেকে আর না ফেরানোর সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বিদায় নিতে হতে পারে তাঁদের। ফলে সব মিলিয়ে ১০–১২টি ব্যাংকে নতুন মুখের দেখা মিলবে। ব্যাংকগুলোয় খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকারদের চাকরির মেয়াদ ৫৯ বছর হলেও এমডিরা সর্বোচ্চ ৬৫ বছর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এমডি হতে ব্যাংকারদের অভিজ্ঞতা থাকতে হয় ২০ বছরের, বয়স হতে হয় ৪৫ বছরের বেশি।
দক্ষ এমডির খোঁজে উদ্যোক্তারা
আগে ব্যাংকের মালিকেরা প্রভাব খাটিয়ে অযোগ্য ও দুর্নীতিতে যুক্ত অনেককে এমডি বানাতে পারলেও এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই অনুমোদন দিচ্ছে না। আগে বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার ও বিতর্কিত এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর মতো ব্যক্তিরা এমডি হতে পেরেছেন। এখন তাঁদের মতো ব্যাংকারদের ঠেকাতে নতুন নীতিমালা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন এমডি হতে ব্যাংকের ব্যবসায়িক লক্ষ্য পূরণের নিশ্চয়তা দেওয়া ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গিয়ে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হচ্ছে। আর প্রতিবার নিয়োগের মেয়াদ হচ্ছে তিন বছর। আগে একবারে পাঁচ বছরের নিয়োগ অনুমোদন করত বাংলাদেশ ব্যাংক।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, মোটা অঙ্কের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা এবং ক্ষমতা থাকায় এমডি পদে বসতে অনেকের আগ্রহ থাকলেও সুযোগ পান অল্প কয়েকজন ব্যাংকার। এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এমডিদের মধ্যে বেশির ভাগেরই শুরুটা বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে। পাশাপাশি এখন ডিএমডিদেরও অনেকের শুরুটা বিদেশি ব্যাংকে। তাঁরাও ব্যাংকের শীর্ষ পদে বসতে চান।
এমডি হিসেবে সামনের বছরে আমার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তার আগে ব্যাংকটিকে আরও গুছিয়ে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে যেতে চাই
কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির কারণে ব্যাংকিং ব্যবসা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। এ জন্য এখন সবাই এমডি পদে দক্ষ ব্যাংকারদের পাশাপাশি সুনাম আছে এমন ব্যক্তিদেরই খুঁজছেন। কিন্তু এমন কর্মকর্তা দেশের ব্যাংকগুলোয় খুব বেশি নেই। বাংলাদেশি ব্যাংকার, তবে বিদেশের ব্যাংকে উচ্চপদে কর্মরত আছেন, এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন অনেকে। এরই মধ্যে ইস্টার্ণ ব্যাংকের (ইবিএল) অতিরিক্ত এমডি হিসেবে যোগ দিয়েছেন ওসমান এরশাদ ফয়েজ। তিনি সিঙ্গাপুরভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ও ফিনটেক কনসালট্যান্সি প্রতিষ্ঠান এশিয়া এফআইআইটির সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তারও আগে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড সিঙ্গাপুরের এমডি ও প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ছিলেন। একইভাবে স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যক্রমের প্রধান নির্বাহী ছিলেন এমন একজনকে দেশের একটি ব্যাংক এমডি করার বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
নতুন মুখ আসবে যেসব ব্যাংকে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিনের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি। তিনি ২০১৬ সালে ব্যাংকটির এমডি হিসেবে দায়িত্ব নেন। মিডল্যান্ড ব্যাংকের এমডি আহসান-উজ জামান তাঁর মেয়াদ শেষ করবেন একই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি, তিনি ২০১৪ সাল থেকে একই পদে আছেন।
ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেনের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ৪ মার্চ। তিনি ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্সের এমডি ছিলেন। একই মাসে এমডি পদে যোগ দেন ব্র্যাক ব্যাংকে। ইস্টার্ণ ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার আগামী বছরের ১৯ এপ্রিল মেয়াদ শেষ করবেন। তিনি ২০০৭ সাল থেকে এই পদে আছেন।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের মেয়াদ ২০২৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি শেষ হবে। ২০১০ সাল থেকে তিনি এমডি, এর আগে ছিলেন ব্র্যাক ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংকে। গত ১৫ বছরে বেসরকারি ব্যাংক এমডিদের মধ্যে ব্যাংক খাতের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন। মেয়াদ শেষ করতে যাওয়া এসব শীর্ষ নির্বাহী ব্যাংক খাতের এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) নেতৃত্বে ছিলেন বা আছেন। তাঁরা ব্যাংক খাতে প্রভাবশালী নির্বাহী হিসেবেও পরিচিত। ব্যাংক খাতের বিভিন্ন নীতিমালা ও আইন প্রণয়নে তাঁদের ভূমিকা রয়েছে।
এ ছাড়া কমিউনিটি ব্যাংকের এমডি মশিহুল হক চৌধুরীর মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। ব্যাংকটিতে নতুন এমডি নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। সিটিজেনস ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ মাসুমের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তাঁর স্থলে ব্যাংক এশিয়ার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আলমগীর হোসেনকে এমডি পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটিজেনস ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক তা অনুমোদন করলে এ নিয়োগ চূড়ান্ত হবে। গত বছরের অক্টোবরে ঢাকা ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন শেখ মোহাম্মদ মারুফ। এর আগে তিনি সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত এমডি ছিলেন। বলা হচ্ছে, যেসব ব্যাংকের এমডি পদ শূন্য হবে তার অনেকগুলোই পূরণ করতে হবে অতিরিক্ত এমডি থাকা কর্মকর্তাদের দিয়ে।
এদিকে অনিয়মে দুর্বল হয়ে পড়া ছয় ব্যাংকে গত জানুয়ারিতে নিরীক্ষা শুরু করেছেন বিদেশি নিরীক্ষকেরা। এ জন্য এই ব্যাংকগুলোর এমডিদের তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। ব্যাংক ছয়টি হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন, এক্সিম ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. হুমায়ুন কবির। আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের এমডি পদে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল ইসলামের নাম প্রস্তাব করেছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। এক্সিম ব্যাংকের অতিরিক্ত এমডি হিসেবে যোগ দিয়েছেন এম আখতার হোসেন ও আবদুল আজিজ। তাঁরা দুজনই শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন।
জানতে চাইলে ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমডি হিসেবে সামনের বছরে আমার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তার আগে ব্যাংকটিকে আরও গুছিয়ে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে যেতে চাই।’