বেসিক ব্যাংকে টাকা তোলার হিড়িক, একীভূত করার সিদ্ধান্তের প্রভাব

ব্যাংকটি বলছে, অস্বাভাবিকভাবে আমানত উত্তোলনের ফলে ব্যাংক গভীর সংকটে পড়েছে। আমানতকারীরা ২,৫০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন।

বেসিক ব্যাংক

বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের একীভূত হওয়ার খবরে ব্যাংকটি থেকে আমানতকারীরা ইতিমধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বেসিক ব্যাংক চরম তারল্যসংকটে পড়েছে। ব্যাংকটি অন্য কোনো ব্যাংক থেকে টাকা ধার পাচ্ছে না, এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিশেষ কোনো সহায়তা করছে না। ফলে গ্রাহকদের টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ব্যাংক যেকোনো মুহূর্তে ব্যর্থ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের কাছে সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিসুর রহমান।

৭ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে পাঠানো এক চিঠিতে এমন দুরবস্থার কথা তুলে ধরেছে বেসিক ব্যাংক।

ব্যাংকটিতে সমস্যা আছে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংকটিকে একীভূত করার চেষ্টা করা হয়েছে, তা ঠিক হয়নি। এখন সৃষ্টি হওয়া সংকট বাংলাদেশ ব্যাংককেই মেটাতে হবে।
আলাউদ্দিন এ মজিদ, সাবেক চেয়ারম্যান, বেসিক ব্যাংক

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বেসিক ব্যাংককে আর কোনো সহায়তা না দেওয়ার অবস্থানে রয়েছে। একীভূত হতে রাজি না হওয়ার কারণেই ব্যাংকটিকে এভাবে কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে ব্যাংকটির এমডি কথা বলতে রাজি হননি। চেয়ারম্যানও ফোনে সাড়া দেননি।

তবে বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকটিতে সমস্যা আছে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংকটিকে একীভূত করার চেষ্টা করা হয়েছে, তা ঠিক হয়নি। এখন সৃষ্টি হওয়া সংকট বাংলাদেশ ব্যাংককেই মেটাতে হবে। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো ব্যাংক খাতের অভিভাবক।’

বেসিক ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘গত ৮ এপ্রিল গণমাধ্যমে একটি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে বেসিক ব্যাংকের একীভূতকরণের সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে অস্বাভাবিকভাবে আমানত উত্তোলনের ফলে ব্যাংকটি গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে। আমানতকারীরা ইতিমধ্যে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা উত্তোলন করে নিয়েছেন। সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর ও সংস্থা আরও আমানত উত্তোলনের জন্য ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য কোনো উৎস থেকে নতুন করে আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া প্রতিনিয়ত ব্যক্তিপর্যায়েও অস্বাভাবিকভাবে আমানত উত্তোলন করা হচ্ছে।’

আরও পড়ুন

চিঠিতে আরও বলা হয়, বর্তমানে বেসিক ব্যাংকের পক্ষে বন্ড রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেওয়ার সুযোগ নেই বা শেষ হয়ে গেছে। আন্তব্যাংক কলমানি মার্কেট থেকেও টাকা ধার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সৃষ্টি হওয়া আতঙ্কে বেসিক ব্যাংকে মারাত্মক তারল্যসংকট সৃষ্টি হয়েছে। এই সংকটে ব্যাংকের বিধিবদ্ধ তারল্য মজুতে (এসএলআর) ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

ব্যাংকটি জানিয়েছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে তারা অচিরেই গভীর সংকটে পড়বে, যার নেতিবাচক প্রভাব পুরো ব্যাংকিং খাতের ওপর পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। এ ছাড়া হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া পরিস্থিতি সামাল দেওয়া না গেলে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন-ভাতা অনিশ্চিয়তায় পড়বে।

এ জন্য সরকারের কাছে বেশ কিছু প্রস্তাব রেখেছে ব্যাংকটি। এতে বলা হয়েছে, বেসিক ব্যাংক একটি সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক এবং এ ব্যাংকে আমানত রাখা ঝুঁকিমুক্ত এবং নিরাপদ—এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও দপ্তরকে চিঠি দেওয়া যেতে পারে। আমানত দেওয়া সরকারি সংস্থাগুলোকে আমানত সংরক্ষণের পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রদান করা ও স্বল্প সুদে সরকার থেকে আমানত সরবরাহসহ নীতি–সহায়তা প্রদানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। একীভূতকরণ সংশ্লিষ্ট সংবাদটির বিষয়ে মালিকপক্ষ হিসেবে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করা।

একসময় ভালো ব্যবসায়ীরা ছিলেন বেসিক ব্যাংকের গ্রাহক। দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও ভালো সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ফলে এই ব্যাংকে কর্মী হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর আগ্রহ দেখা যেত। বেসিক ব্যাংককে ডোবানোর কাজ শুরু হয় মূলত ২০০৯ সালে সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার পর থেকে। ব্যাংকটিতে অপরাধ চলছে জেনেও তাঁর মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০০৯-১৪ সালে তাঁর মেয়াদে নজিরবিহীন অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংকটির অর্থ লুটে নেওয়া হয়েছে সবার চোখের সামনেই। ফলে ব্যাংকটিকে একীভূত করার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বেসিক ব্যাংকের দেওয়া ঋণের ৬৪ শতাংশই এখন খেলাপি। গত ১০ বছরে ব্যাংকটির লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৩০ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক হিসেবে ব্যাংকের মোট আমানতের প্রায় ৮০ শতাংশ আমানত সরকারি উৎস হতে সংগ্রহ করা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ আমানত উচ্চ সুদের। খেলাপি ঋণ বেশি হওয়ায় ও উচ্চ সুদের আমানত নেওয়ার কারণে ব্যাংকের মূল ব্যবসায়িক সূচকগুলো ভালো থাকা সত্ত্বেও লোকসান হচ্ছে। এতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি ও মূলধন ঘাটতি হচ্ছে।’

বেসিক ব্যাংক নিজেদের ব্যবসার চিত্র তুলে ধরে জানায়, নতুন করে সৃষ্টি হওয়া সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় বেসিক ব্যাংকের পক্ষে তা এককভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয় বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।