বিদেশি কাগুজে মুদ্রা হাতে নেওয়ার সুযোগ হলে আপনি নিশ্চয় খেয়াল করেছেন বেশির ভাগ দেশের নোট অনেক পুরোনো হলেও সেগুলো ছেঁড়া-ফাটা বা তাতে পিন মারার কোনো চিহ্ন থাকে না। কিন্তু এখনই মানিব্যাগ খুলে টাকা বের করে দেখুন, সেগুলো ছেঁড়া–ফাটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং নিশ্চিতভাবে নতুন টাকায় পিন মারার চিহ্ন খুঁজে পাবেন।
আবার টাকার বান্ডিল থেকে পিন খুলতে গিয়ে সামান্য হলেও আহত হয়েছেন এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে অনেকেরই।
আগে একসময় ‘ভোমর’ দিয়ে ছিদ্র করে সুতা দিয়ে টাকার বান্ডিল বাঁধা প্রচলিত ছিল। এখন এই প্রবণতা কিছুটা কমে এলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দফায় দফায় দেওয়া নির্দেশনা উপেক্ষা করে ব্যবসায়ী বা ব্যক্তি পর্যায় তো বটেই, বাণিজ্যিক ব্যাংকেও হরহামেশা টাকার বান্ডিলে পিন মারা হচ্ছে। টাকায় পিন না মারার বিষয়ে যে কর্তৃপক্ষের বিধিনিষেধ আছে, তা অবশ্য ব্যাংকার ছাড়া সাধারণ মানুষ জানেও কম। এ ব্যাপারে প্রচার–প্রচারণাও তেমন চোখে পড়ে না।
বিষয়টি নিয়ে পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পিন মারলে টাকার ক্ষতি হবে এই বিষয়টিকে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন না। ব্যাংক থেকে টাকা আনতে গেলে পিন মারা বান্ডিলই দেয়। এভাবে টাকা নিতে কিছুটা সুবিধা হয় বটে। তবে অনেক ক্ষেত্রে মজবুত করে লাগানো পিন খুলতে গিয়ে হাত কাটে। আবার টাকাও নষ্ট হয়।
টাকার বান্ডিলে কাগুজে একধরনের টেপের ব্যবহার হলেও তা খুবই সীমিত বলে জানান এই ব্যবসায়ী।
টাকায় কেন পিন
ব্যাংকাররা বলছেন, বড় অঙ্কের টাকা উত্তোলনের পরে গ্রাহকের চাহিদা থাকে টাকাগুলো ভালোভাবে সাজিয়ে দেওয়ার। সে ক্ষেত্রে পিন মারলে সুবিধা হয়। এক মাথায় পিন মারার ফলে টাকা গুনতেও সুবিধা। আবার গ্রাহক টাকা গোনার সময় কৌশলে যাতে টাকা না সরাতে পারে, সে জন্যও পিনের ব্যবহার হয়।
তাঁরা বলেন, কাগুজে টেপ দিয়ে বান্ডিল করার চেয়ে টাকা ব্যবস্থাপনায় পিন মারার পদ্ধতিই বেশি জনপ্রিয়। পিন মারা বা স্ট্যাপলিং করার জন্য ব্যাংক বিভিন্ন ব্রাঞ্চে বড় মেশিনও রাখে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা দিলে ব্যাংকগুলো তা পালন করতে বাধ্য। কিন্তু কাজের সুবিধা হয় বলে কর্মীরা পিন ব্যবহার করেন। দৈনন্দিন কাজের মধ্যে ক্যাশ–ব্যবস্থাপনা চাপযুক্ত একটি কাজ। সুতরাং এ ক্ষেত্রে কর্মীরা কিছুটা ছাড় পায়। তবে দেশের স্বার্থে টাকায় কাগজের ব্যান্ডিং হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
মুদ্রা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বাজারে চালু একটি নোট কত দিন টিকে থাকতে পারে, তা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। তবে এই কর্মকর্তাদের ধারণা, একটা নোট যদি প্রতিদিন হাতবদল হয়, তাহলে সেটি ৫ থেকে ৬ বছর প্রচলনযোগ্য থাকে। বিদেশি নোট যেমন ডলার বা রুপির ক্ষেত্রে যেহেতু পিনের ব্যবহার হয় না, সে ক্ষেত্রে এসব নোট টিকে থাকে ৭ থেকে ৮ বছর পর্যন্ত।
প্রশ্ন উঠতেই পারে যে একটা পিনের কারণে তো আর টাকা প্রচলন অযোগ্য হচ্ছে না, তাই এ নিয়ে এত কথা বলার কারণ কী? কথা বলার কারণ খুব সাধারণ, পিন মারার ফলে ব্যাংকনোটের স্থায়িত্ব কমে যায়। টাকা দ্রুত নষ্ট হওয়ার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এসব নোট তুলে নিয়ে নতুন টাকা বাজারে নিয়ে আসতে হচ্ছে। এতে খরচ বাড়ছে।
শুধু কি তাই, নতুন ব্যাংকনোট বাজারে নিয়ে আসার ঝামেলাও অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি যেমন দেখতে হয়, তেমনি টাকা ছাপানোর উপকরণ পেতেও বেশ বেগ পেতে হয়। কারণ, টাকা ছাপানোর প্রায় সব কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ডলারের দাম বেশি থাকায় এখন আবার আমদানি খরচও বাড়তি।
প্রতিবছরই কমবেশি টাকা ছাপাতে হয়। টাকা ছাপানোর এ সিদ্ধান্তটি আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। আর ছাপানোর কাজটি করে সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংকের তো বটেই, সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রে ছাপার কাজটিও করে।
টাকা ছাপানোর জন্য প্রয়োজন হয় নীতিগত অনেক সিদ্ধান্তের। সেই নীতি তৈরি ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
পিনের বিকল্প কী
ব্যাংকনোট সংরক্ষণের জন্য পিনের বিকল্প হিসেবে আছে কাগজের ব্যান্ডিং। কাগুজে একধরনের টেপের ব্যবহারও হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এভাবে কাগুজে মুদ্রার বান্ডিল করা হয়। এ ছাড়া রবার দিয়ে টাকা আটকানোর পুরোনো পদ্ধতিও পিনের চেয়ে বেশি নিরাপদ।
তবে পিনের বিকল্প এসব কাগজ অথবা কাগুজে টেপের ব্যবহার করতে হলো দরকার হয় বিশেষ এক মেশিনের। এই মেশিন বড় ব্যাংকের করপোরেট শাখা বা তুলনামূলক আধুনিক সুবিধা আছে এমন শাখায় দেখা যায়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শাখা-উপশাখায় এখনো এই মেশিন নিশ্চিত করা যায়নি বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এ–সম্পর্কিত সর্বশেষ যে পরিপত্র জারি করেছিল, সেখানে বলা হয় নোটের ওপর লেখা, স্বাক্ষর, সিল এবং এক হাজার টাকার নোট ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে স্ট্যাপলিং করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ছাড়া টাকার প্যাকেটে নোটের সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে প্যাকেট ব্যান্ডিং করার পর সংশ্লিষ্ট শাখার নাম, সিল, নোট গণনাকারীর স্বাক্ষর ও তারিখ দেওয়ার বিষয়টি কঠোরভাবে পরিপালন করার নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
টাকা ছাপানোর খরচ কেমন
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে টাকা ছাপাতে প্রতিবছর খরচ করতে হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ কোটি টাকা। এই খরচ হয়ে থাকে নোট ছাপার বিভিন্ন উপকরণ যেমন কাগজ, কালি, নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যসহ অন্যান্য সামগ্রী কিনতে। এসব সামগ্রী বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর বাইরে নোট পরিবহন, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, অপ্রচলনযোগ্য নোট পুড়িয়ে ফেলার ক্ষেত্রে আরও খরচ রয়েছে। সব মিলিয়ে টাকার মুদ্রণ ব্যবস্থাপনা একটি ব্যয়বহুল বিষয়।
সূত্র অনুযায়ী, বর্তমানে একটি এক হাজার টাকার নতুন নোট তৈরিতে খরচ হয় সাড়ে চার টাকার মতো। নতুন একটি ৫০০ টাকার নোটের ক্ষেত্রেও প্রায় একই পরিমাণ খরচ হয়ে থাকে। অর্থনীতির আকার বাড়তে থাকায় বাজারে এখন বেশি পরিমাণে নোট লাগে। ফলে গত ১৫ থেকে ২০ বছরে নতুন টাকা ছাপাতে সরকারের খরচ ৭ থেকে ৮ গুণ বেড়ে গেছে।
মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার প্রতিফলন না হওয়া, টাকা ছাপানোর খরচ ও বছর বছর সরকারের খরচ বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, নোটগুলো যাতে দ্রুত নষ্ট না হয় এ জন্য পরিপত্র জারি করে ব্যাংকগুলোকে পিনের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যাংক ছাড়াও সর্বসাধারণের সচেতনতা প্রয়োজন। তাহলে টাকার স্থায়িত্ব বাড়বে, নতুন টাকা ছাপানো কমে আসবে এবং বাড়তি অর্থ খরচ করতে হবে না।