আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের ৮০ শাখায় মাত্র একজন করে লোক

  • ব্যাংকটির অনুমোদিত জনবল ২,৪৩৮, বর্তমানে আছেন মাত্র ৬০০ জন।

  • বর্তমানে সারা দেশে ব্যাংকটির শাখা রয়েছে ২৫৯টি।

খেলাপি ঋণপ্রতীকী ছবি

অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা—এই তিন কারণে বিশেষায়িত আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে প্রায় ১৩ শতাংশে উঠেছে। অথচ মাত্র ছয় মাস আগেও এই হার ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

সম্প্রতি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হকের কাছে শেয়ারহোল্ডার ও কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে পাঠানো এক চিঠিতে এমন চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের অনুমোদিত জনবল ২ হাজার ৪৩৮ হলেও বর্তমানে আছে মাত্র ৬০০ জন। আর মাত্র একজন করে লোক দিয়ে চলছে ব্যাংকের এক-তৃতীয়াংশ বা ৮০টি শাখা। সে জন্য ব্যাংকে নতুন লোক নিয়োগের দাবি জানানো হয়েছে চিঠিতে।

ব্যাংকটিতে চার বছর আগে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯.৭৩%, যা বেড়ে গত ডিসেম্বরে ১২.৬৬% শতাংশে উঠেছে।

এ নিয়ে ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পারভীন সুলতানা গত বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, যে কথাগুলো এসেছে, তা অসত্য নয়। জনবলের সংকট আছে। নতুন লোক নিয়োগের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আর খেলাপি ঋণের হার বৃদ্ধির সমস্যা পুরো ব্যাংক খাতেরই, যে ধাক্কা এই ব্যাংকেও লেগেছে।

৮ পৃষ্ঠার ওই চিঠির কপি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগেও পাঠানো হয়েছে। এতে ৬২ লাখ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে কার্যকর ভূমিকা পালনের অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আবদুর রহমান খান প্রথম আলোকে শুধু এটুকু জানান, বিষয়টির তিনি খোঁজ নেবেন।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন বিশেষায়িত এ ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও এ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার। ব্যাংকটির মোট শেয়ারহোল্ডার ২২ লাখ। বর্তমানে এর ২৫৯টি শাখা রয়েছে।

চিঠির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ৩০ জুন ব্যাংকটিতে ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ বা ১৪০ কোটি টাকা ছিল খেলাপি ঋণ। পরের বছর ২০২২ সালের জুনে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে হয় ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরে ঋণ বাড়ে ১ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ছিল ১৭০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুনে ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা, যার ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ বা ১৯২ কোটি টাকা খেলাপি। এর ছয় মাস পর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি দেখা যায় ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ বা ২৩০ কোটি টাকা।

চিঠিতে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ কমানোর কথা বলে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যেই কমিটি গঠন করে। কিন্তু সেগুলো অকার্যকর কমিটিতে পরিণত হয়। তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক হিসাব সংরক্ষণ ও তদারকের ব্যবস্থা থাকলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসত।

আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোসাদ্দেক-উল-আলমের সময়েই ব্যাংকটি বেশি খারাপ হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। তিনি সম্প্রতি অবসরে গেছেন এবং এখন বিদেশে রয়েছেন। এ জন্য তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

৮০ শাখায় ১ জন করে লোক

কর্মকর্তা ও শেয়ারধারীদের ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, এ ব্যাংকের মোট শাখা ২৫৯। এর মধ্যে মাত্র একজন করে লোক দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে ৮০টি বা এক-তৃতীয়াংশ শাখা। বাকি ১৭৯টি বা দুই-তৃতীয়াংশ শাখায়ও রয়েছে দুজন করে বা ততোধিক কর্মকর্তা। অথচ ব্যাংকের একটি ভাউচারে কমপক্ষে দুজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর থাকার নিয়ম রয়েছে।

এদিকে আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের সর্বশেষ জনবল-কাঠামোয় উল্লেখ রয়েছে, সি গ্রেড বা নিম্নস্তরের শাখাও কমপক্ষে ৬ জন লোকের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে। বাণিজ্যিক নিরীক্ষা অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষায় বছরের পর বছর ধরে বিষয়টি উত্থাপিত হচ্ছে; কিন্তু সমাধানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। 

সরকার যখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নামে নতুন রূপকল্প নিয়ে এগোচ্ছে, তখন আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক চলছে মান্ধাতার আমলের সেবার ওপর ভিত্তি করে। ২০১৬ সালে ব্যাংকটি কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের (সিবিএস) মাধ্যমে গ্রাহকসেবা দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নেয়। এ জন্য ব্যাংকটি ‘ইনফিনিটি’ নামক একটি দুর্বল কোম্পানির কাছ থেকে সিবিএস কিনেছে। এর মাধ্যমে মাত্র ৬৬টি শাখায় সীমিত পরিসরে সিবিএস সেবা চালু করতে পেরেছে এ ব্যাংক। চিঠিতে বলা হয়, সেবা আধুনিকায়নে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না; বরং ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে ইনফিনিটির দুর্বল সেবা কার্যক্রম বছরের পর বছর ধরে চালু রয়েছে। ফলে গ্রাহকদের তথ্য যথাযথভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে না এবং দেখা দিয়েছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি। 

শেয়ার বিক্রি চলছেই

ব্যাংকের মূলধন বৃদ্ধির জন্য আনসার-ভিডিপি বাহিনীর সব সদস্যের কাছে শেয়ার বিক্রির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আনসার বাহিনীর বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে মাসিক ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা নিয়ে শেয়ার বিক্রি করা হয়। কিন্তু ২০২০ সালের জুনের পর শেয়ার বিক্রির তথ্য হালনাগাদ করা হয়নি। লভ্যাংশ দেওয়ার নামে একটি অকার্যকর ও বাস্তবতাবিবর্জিত পদ্ধতি গ্রহণ করায় শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেওয়ার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে চিঠিতে বলা হয়।

ব্যাংকটির পরিস্থিতি তুলে ধরলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, যা বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কোনো দিক থেকেই ব্যাংকটির প্রতি ভালো নজর দেওয়া হয়নি। অনেক বছর আগে এ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে ভালো কোনো ধারণা পাননি (ইমপ্রেসড হননি) বলেও জানান তিনি।

সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, এই ব্যাংকের বেশির ভাগ শেয়ারহোল্ডার দরিদ্র শ্রেণির আনসার-ভিডিপির সদস্য। এটি যে এত দূর পর্যন্ত এসেছে, তা-ও কম নয়। এ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন ঘটাতে হবে। দরকার হলে ব্যাংকটিকে উদ্ধারে অন্য ব্যাংক থেকে ভালো ও দক্ষ ব্যাংকার এনে নিয়োগ দিতে হবে।