আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভ নেই বাংলাদেশের
বাংলাদেশকে দেওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল—গত জুনে প্রকৃত (নিট) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকতে হবে ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে দেশের মোট (গ্রস) রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার।
আর আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ (ব্যালান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) অনুযায়ী রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৪৭৫ কোটি ডলার। এর বাইরেও প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি তথ্য আছে, যা প্রকাশ করেনি তারা।
যদিও দেশের মানুষকে না জানালেও ঋণের শর্ত মেনে প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব ঠিকই প্রতিদিন আইএমএফকে জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেমন সর্বশেষ প্রায় ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি ডলারের কিছু বেশি প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা আইএমএফকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন রিজার্ভের তিন ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেমন মোট রিজার্ভ, বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ও প্রকৃত রিজার্ভ।
প্রকৃত রিজার্ভ দিয়ে এখন তিন মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করা যাবে। গত মে মাসে আমদানি খরচ ছিল ৬৪৬ কোটি ডলার। রিজার্ভ কমতে থাকায় ডলার বিক্রি কমিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সরকারি আমদানি বিঘ্নিত হতে পারে। এর আগে রিজার্ভ থেকে ডলার না দেওয়ায় বিদ্যুৎ-সংকট শুরু হয়েছিল। সাধারণভাবে বলা হয়, তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকাটা অর্থনীতির জন্য স্বস্তিপূর্ণ।
শর্তমতো প্রকৃত রিজার্ভ না থাকায় আইএমএফের ঋণের কিস্তি আটকে যেতে পারে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জুনে শর্ত অনুযায়ী মোট রিজার্ভ ছিল না। আইএমএফ যে শর্ত দিয়েছিল, তা পূরণ না হলে সাধারণত ঋণের কিস্তি আটকে দেয়। তবে এই শর্ত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার উপায় আছে। এ জন্য রিজার্ভ বাড়াতে কী কী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা উল্লেখ করে চিঠি দিতে হবে। আইএমএফ সম্মত হলে কিস্তি ছাড় করবে।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, রিজার্ভ বাড়াতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিন ডলার বিক্রি করে রিজার্ভ অর্ধেক করে ফেলেছে। সরকার চাহিদা কমিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছিল, এটা সফল হয়নি। ডলারের জোগান বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই, এ জন্য ডলারের দামের সীমা তুলে দিতে হবে। এতে সমস্যা মিটবে তা বলা যাচ্ছে না, তবে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
আইএমএফের ঋণ ও প্রকৃত রিজার্ভ
বিভিন্ন খাতে শর্ত পূরণের লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে দিয়ে আইএমএফ ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে গত জানুয়ারি মাসের শেষে। এই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ পেয়েছে। এই শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল জুনে প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার, আগামী সেপ্টেম্বরে তা ২ হাজার ৫৩০ ডলার এবং ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৮০ ডলারে রাখতে হবে। এ জন্য লিখিতভাবে বাংলাদেশকে প্রকৃত রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতি জানিয়ে দেয় আইএমএফ। এই হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য আইএমএফকে জানানো শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আইএমএফের দেওয়া লিখিত হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করে দেখা গেছে, বিপিএম ৬ অনুযায়ী থাকা রিজার্ভের তুলনায় তা প্রায় ৪৫০ কোটি ডলার কম। এর মধ্য থেকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় বাবদ বাদ পড়বে ১০৯ কোটি ডলার, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা ১২৫ কোটি ডলার ও স্পেশাল ড্রয়িং রাইট (এসডিআর) হিসেবে থাকা ২০৪ কোটি ডলার। ফলে প্রকৃত রিজার্ভ কমে হয় ২ হাজার ৩৭ কোটি ডলার।
আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি
গত জুনের মধ্যে রিজার্ভের মজুত হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী শুরু করতে বাংলাদেশকে শর্ত দিয়েছিল আইএমএফ। উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও রিপোর্টিংয়ের মান বাড়ানো। আইএমএফের ঋণের আরও শর্ত ছিল, রিজার্ভ থেকে গঠন করা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ বাদ দিতে হবে। এ ছাড়া প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব করতে রিজার্ভের অর্থে গঠন করা লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ) ও গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ), বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতে সোনালী ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে দেওয়া অর্থ এবং পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতে রিজার্ভ থেকে দেওয়া অর্থ বাদ দিতে হবে।
রিজার্ভ ধারণের লক্ষ্য পূরণ হলো কি না, তা জানতে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফ শুধু রিজার্ভ নিয়ে লক্ষ্য দেয়নি, আরও অনেক বিষয় আছে। তাদের সুপারিশ পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। সব লক্ষ্য পূরণ হলো কি না, এটা দেখার বিষয় আছে। আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা হলে তখন সব তথ্য পাওয়া যাবে। তখন আইএমএফকে সার্বিক পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলা হবে।
ডলার পরিস্থিতি
গত বছরের এপ্রিলে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ডলার-সংকট শুরু হয়। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি ও নানা পদক্ষেপের পর ডলার-সংকট কিছুটা কমেছে। তবে রিজার্ভের মজুত ৪৮ বিলিয়ন থেকে দুই বছরে ২৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ১ হাজার ৩৮৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছিল ৭৬২ কোটি ডলার।
এদিকে ডলারের দাম গত দেড় বছরে ৮৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০৯ টাকা। এতে খাদ্য ও পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় ১০ শতাংশ। এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পরই ডলারের জন্য আইএমএফের দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ।
এখন আমদানি দায় পরিশোধে ডলারের দাম ১০৯ টাকা। তবে কাউকে কাউকে ১১২-১১৩ টাকাও দিতে হচ্ছে। প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম এখন ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা ও রপ্তানি আয়ে ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা। ব্যাংকে চাহিদামতো ডলার না পেয়ে অনেকে ব্যবসা ছোট করে এনেছেন, অনেক আমদানিকারক ব্যবসা গুটিয়েও ফেলেছেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।