বাংলাদেশ ব্যাংকের শাস্তি, ১০ ট্রেজারিপ্রধানকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা
গত ১৮ সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠানো হয়। ব্যাংকগুলোর ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হওয়ায় জরিমানা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নির্ধারিত দরের চেয়ে অতিরিক্ত দামে ডলার কেনাবেচা করার অভিযোগে ১০ বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানদের জরিমানা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রত্যেক ট্রেজারিপ্রধানকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি পাঠিয়েছে। এর আগে ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তবে এবার একসঙ্গে ১০ ট্রেজারিপ্রধানদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলো।
এসব কর্মকর্তাকে শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৮ সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠিয়েছিল। এর আগেও ৩ সেপ্টেম্বর অভিযোগ জানিয়ে প্রথম চিঠি পাঠানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছিল, বেশি দামে ডলার বেচাকেনার দায় ট্রেজারিপ্রধানেরা এড়াতে পারেন না। জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর ‘ব্যাখ্যা সন্তোষজনক হয়নি’, সে কারণে জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বেঁধে দেওয়া দামে ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় আনতে পারছে না। কারণ, ব্যাংকের বাইরে ডলারের দাম বেশি। পরিস্থিতি বিবেচনায় এ ধরনের পদক্ষেপ নৈতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে ভাবতে হবে।মুস্তফা কে মুজেরী, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক
যে ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানদের জরিমানা করা হয়েছে, সেগুলো হলো মার্কেন্টাইল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যাংকগুলোর সূত্রে এ খবর পাওয়া গেছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ট্রেজারি বিভাগ টাকা ও ডলারের চাহিদা-জোগানের বিষয়টি নিশ্চিত করে থাকে। কোনো কোনো ব্যাংকে ট্রেজারি বিভাগের প্রধান পদে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাও রয়েছেন।
একাধিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, বেশির ভাগ ট্রেজারিপ্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে তাঁদের ব্যাংক আমদানিকারকদের কাছে বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রি করেছে। তবে দু–একজন ট্রেজারিপ্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত দামে প্রবাসী আয় কিনেছে।
বেঁধে দেওয়া দামের তুলনায় বেশি দামে ডলার কেনাবেচার অভিযোগে গত বছরের আগস্টে দেশি-বিদেশি ছয় ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক রোববার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি কিছু জানতে পারেননি। সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাঁকে তখনো কিছু জানায়নি।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক জরিমানা করেছে, এমন একাধিক কর্মকর্তা চিঠি পাওয়ার বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন।
চিঠিতে যা বলা হয়েছে
একাধিক ট্রেজারিপ্রধান জানিয়েছেন, তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সংক্ষিপ্ত চিঠি পেয়েছেন। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১০৯ (৭) ধারা অনুযায়ী আপনাকে জরিমানা করা হলো। আগামী ১৪ দিনের মধ্যে তাঁদের অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। দশটি ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য কোনে পদক্ষেপ নেয়নি।
শাস্তি পাওয়া যেসব কর্মকর্তার সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়েছে, তাঁরা জানান, এই শাস্তির বিরুদ্ধে তাঁরা আপিল করবেন।
আগের চিঠি
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ১০ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে, ‘গত ৩ সেপ্টেম্বর পাঠানো চিঠিতে আমদানি বিল পরিশোধের জন্য করপোরেট ডিলের নামে গ্রাহকের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্টকৃত ও ব্যাংকের ঘোষিত দরের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণের অভিযোগের বিপরীতে আপনাদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হয়নি। বেশি দামে ডলার লেনদেনে আপনাদের ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান তাঁর দায় এড়াতে পারেন না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে গত বছরের শেষ প্রান্তিক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ডলারের দাম নির্ধারণ করছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক একটি গ্রুপ সম্প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায়ে আমদানি ব্যয় উল্লেখ করে একগুচ্ছ নথিপত্র জমা দেয়। এসব নথি পরে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক দল অভিযুক্ত ব্যাংকগুলোর শাখা ও প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করে।
বছর দেড়েক ধরে চলা ডলার-সংকট এখনো কাটেনি। এই সময়ে রিজার্ভ কমে প্রায় অর্ধেক হয়েছে। আমদানিকারকেরা বলছেন, তাঁরা চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। খোলাবাজারেও নগদ ডলারের সংকট চলছে।
ট্রেজারিপ্রধানদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে জোর করে সেই দামে ডলার বেচাকেনার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। বেঁধে দেওয়া দামে ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় আনতে পারছে না। কারণ, ব্যাংকের বাইরে ডলারের দাম বেশি। পরিস্থিতি বিবেচনায় এ ধরনের পদক্ষেপ নৈতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে ভাবতে হবে।