আওয়ামী লীগের শাসনামলে দিনদুপুরে ব্যাংক দখল করা ছিল প্রকাশ্য বিষয়। এতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা থেকে শুরু করে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও সমর্থন ছিল। তার ওপর ইসলামি ধারার কয়েকটি ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে দেওয়ার পর তা ঋণের নামে লোপাট করা হয়। ঋণ জালিয়াতির টাকাগুলো পাচার করা হয় বিদেশে। তাতে আমানতকারীদের জমানো অর্থের নিরাপত্তা কমে যায়। এ ছাড়া ব্যাংকঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে ও ডলারের দাম আটকে রেখে একশ্রেণীর ব্যবসায়ীকে সুবিধা দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে বেসামাল হয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতি।
৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ শুরু হয়। এতে ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পষর্দ ভেঙে সেগুলোর আসল চিত্র বের করে আনা, খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা উদ্ঘাটন ও মার্কিন ডলারের সংকট মেটানো—এগুলো প্রাধান্য পায়। এরই মধ্যে ডলারের সংকট মিটিয়ে রিজার্ভের পতন থামানো গেছে। ব্যাংক খাতে অবাধ লুটপাট বন্ধ হয়েছে। তবে অন্যান্য উদ্যোগের সুফল পাওয়া নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সরকার ও গভর্নরের যে তাড়না রয়েছে, ততটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে না। ফলে সংস্কারপ্রক্রিয়ার গতি ইতিমধ্যে ধীর হয়ে পড়েছে।
ব্যাংক খাত সংস্কার ও পাচার করা অর্থ উদ্ধারে ইতিমধ্যে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, একটি পরিষ্কার পথনকশা না থাকায় তড়িঘড়ি করে নেওয়া সংস্কার উদ্যোগ দুর্বল হয়ে পড়ছে। লুটপাটের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলো বন্ধ করা হবে, নাকি একীভূত হবে কিংবা মালিকানা বদল অথবা মূলধন জোগান দিয়ে শক্তিশালী করা হবে, এসব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তরও মিলছে না।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ বছরে যে জঞ্জাল তৈরি হয়েছে তা পাঁচ মাসে সারবে না। সুদ ও ডলারের দাম নির্দিষ্ট করে রাখার পাশাপাশি নানা অনিয়ম হয়েছিল। তা জেনেও সবাই চুপ ছিল। প্রকাশ্যে এসবের সমালোচনা করা যেত না, এখন তা করা যাচ্ছে। সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে বলার মতো কোনো সমাধান হয়নি। এখনো অনেকে সংস্কারের বিপক্ষে রয়ে গেছেন। এ জন্য এই খাতের সবাইকে যুক্ত করে সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিলে সমাধান মিলবে। তাহলে সামনে নতুন সরকার গঠন হলেও সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া যাবে।
যত সংস্কার
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অর্থনীতির যেসব খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ব্যাংক অন্যতম। এ জন্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় এই খাত। নতুন সরকার গঠনের পর ১১টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পষর্দ ভেঙে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে ১০টির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত ছিল বহুল আলোচিত এস আলম গ্রুপ।
পাশাপাশি মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান নগদের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংক খাত সংস্কারে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনিয়মের শিকার ব্যাংকগুলোর সম্পদের প্রকৃত মান বের করবে এই টাস্কফোর্স। এসব ব্যাংকে ফরেনসিক নিরীক্ষা করবে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, যা শুরু হচ্ছে আগামী মাসেই। এ জন্য একটি পৃথক বিধিও তৈরি করা হয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান বের করার পর এই বিধির অধীনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
১৫ বছরে যে জঞ্জাল তৈরি হয়েছে, তা পাঁচ মাসে সারবে না
এদিকে সরকার বদলের পর নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দেন। পাশাপাশি ডলারের দাম ১২০ টাকা নির্ধারণ করে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত কমবেশি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে ডলারের বাজার। সামনে ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার পরিকল্পনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে নগদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘নগদ লিমিটেড’ ব্যাংকে জমা টাকার অতিরিক্ত ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি তৈরি করেছে। পাশাপাশি অনুমোদনবিহীন পরিবেশকদের মাধ্যমে ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় ডিজিটাল জালিয়াতি।
ক্ষত কতটা
ব্যাংক খাতকে কৃষ্ণগহ্বরের (ব্ল্যাকহোল) সঙ্গে তুলনা করেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যে অর্থ দিয়ে ১৩টি মেট্রোরেল বা ২২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংক খাতে, ফলে খাতটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ব্যাংক খাতের দুর্নীতিবাজেরা সবাই ছিলেন প্রভাবশালী।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি আরও বলেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংক দখল করা হয়েছে। শুধু একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতেই সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়েছিল। এরপর বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদন জমা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আগামী দিনে মোট ঋণের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে। এসব ঋণের বড় অংশই ২০১৭ সালের পর দেওয়া হয়েছে, যার একটি বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে।
সরকার বদল হলেও এসব সংস্কার উদ্যোগ চলমান থাকা উচিত
এদিক ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আহসান এইচ মনসুর বলেন, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) সহায়তায় কয়েকটি ব্যাংক দখল করার পর এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তাঁর সহযোগীরা ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ‘অন্তত’ ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ‘বের করে’ নিয়েছেন। তাঁরা প্রতিদিনই নিজেদের নামে ঋণ অনুমোদন করেছেন। এসব ব্যাংক দখল করে আনুমানিক ২ লাখ কোটি টাকা (১ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার) দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে।
জানা গেছে, এস আলম গ্রুপ একাই ইসলামী ব্যাংকের দেওয়া মোট ঋণের প্রায় অর্ধেক বা ৭৩ হাজার কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ঋণের ৬৪ শতাংশ বা ১৮ হাজার কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৬০ শতাংশ বা ৩৫ হাজার কোটি টাকা ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯০ শতাংশ নিয়ে গেছে। একইভাবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক এবং ইউসিবিতেও গ্রুপটির ঋণ রয়েছে।
এদিকে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাভেদ) ইউসিবি থেকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান আইএফআইসি ব্যাংক থেকে, সিকদার পরিবার ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের অর্থ তুলে নিয়েছে। এসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে। এর ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। দেশের ব্যাংকগুলোতে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। তিন মাসেই ব্যাংকব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে–বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। ফলে ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই বর্তমানে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
এমটিবির এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, ব্যাংক খাত যে পর্যায়ে চলে এসেছে তাতে সংস্কার না হলে অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এই বাস্তবতা সবাইকে বুঝতে হবে। বর্তমান সরকার এটা বুঝতে পেরে উদ্যোগ নিয়েছে। সামনে যাঁরা ক্ষমতায় আসবেন, তাঁদেরও এই বাস্তবতা বুঝতে হবে। তা ছাড়া এখনই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে, বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে হবে।
নজরে এখন ১০ শিল্প গ্রুপ
বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ, রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো এবং ঘুষ–কাণ্ড ও দুর্নীতিসহ অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনের কারণে দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০ শিল্পগোষ্ঠীর অবৈধ অর্থ অর্জন, কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার খতিয়ে দেখতে যৌথ তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এর মধ্যে ৬টি গ্রুপের তদন্তে দুদক ও ৪টির তদন্তে সিআইডি নেতৃত্ব দিচ্ছে। তদন্ত শেষে এসব প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করবে সংস্থা দুটি। দুদক ও সিআইডির যৌথ এ তদন্ত সমন্বয় করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা শাখা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আর আইনি সহায়তা দিচ্ছে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়।
যে ১০ শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে সেগুলো হচ্ছে—এস আলম, বেক্সিমকো, নাবিল, সামিট, ওরিয়ন, জেমকন, নাসা, বসুন্ধরা, সিকদার ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আরামিট গ্রুপ। এর মধ্যে সিআইডি তদন্ত করছে এস আলম, বেক্সিমকো, নাবিল ও জেমকন গ্রুপের আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ পাচারের বিষয়ে। বাকি ৬টির তদন্তে নেতৃত্ব দিচ্ছে দুদক।
দুদক, সিআইডি ও কাস্টমস গোয়েন্দাকে দেওয়া বিএফআইইউর চিঠিতে বলা হয়েছে, এসব গ্রুপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঘুষ, দুর্নীতিসহ অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া এসব ব্যবসায়িক গ্রুপের বিরুদ্ধে কর ও শুল্ক ফাঁকি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অবৈধ পন্থায় বিদেশে অর্থ পাচারের তথ্য রয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমের হালনাগাদ প্রতিবেদন সময়-সময় সংস্থাগুলোকে ‘বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনা ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে আন্তসংস্থা টাস্কফোর্স’ ও বিএফআইইউতে সরবরাহ করতে হবে।
শীর্ষ ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ব্যাংক খাত সংস্কার করে ভালো পথে নেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু কাজে আসছে না। সরকারের মেয়াদের ওপর নির্ভর করছে এই সংস্কারের ফলাফল। সরকার বদল হলেও এসব সংস্কার উদ্যোগ চলমান থাকা উচিত। না হলে এই ব্যাংক খাত নিয়ে দেশের অর্থনীতি ভালো পথে নেওয়া সম্ভব হবে না, যা কোনো সরকারের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।