এবি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, আর্থিক সূচকে অবনতি

সেবায় উৎকর্ষ ঘটিয়ে একসময় গ্রাহক আকর্ষণে অন্যতম সেরা হয়ে উঠেছিল প্রথম প্রজন্মের এবি ব্যাংক। এর নেপথ্যে ছিলেন কর্মকর্তারা। ফলে ব্যাংকটি বিভিন্ন সূচকে বেশ এগিয়ে যায়। কিন্তু পরে শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি এবং উদ্যোক্তাদের অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার কারণে ব্যাংকটির আর্থিক সূচক ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ বেড়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে চাহিদামতো নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখলে এই ব্যাংককে এখন ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে।

দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক থাকলেও কোনো উন্নতি হয়নি। এরপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের বিশেষ ছাড়ে ব্যাংকটি গত বছরে ৭২ কোটি টাকা মুনাফা দেখিয়েছে, যা গত ছয় মাসে আরও কমে হয় ১৪ কোটি টাকা।

এবি ব্যাংকের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন সাবেক বিএনপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকটি ছিল তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। দীর্ঘ সময় তাঁদের পক্ষে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন ওয়াহিদুল হক, যিনি মোরশেদ খানের চা-বাগানের পরিচালক ছিলেন। এরপর সাবেক ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ এ (রুমী) আলীও তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন। তাতেও কোনো উন্নতি হয়নি। এখন ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খায়রুল আলম চৌধুরী।

জানা গেছে, এবি ব্যাংকের শীর্ষ গ্রাহকদের বেশির ভাগই নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছে না। এর মধ্যে অন্যতম হলো সিকদার গ্রুপ, আশিয়ান সিটি, বিল্ডট্রেড, মাহিন গ্রুপ, আমান গ্রুপ, এরশাদ ব্রাদার্স ও স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুর কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণও ঠিকমতো আদায় করতে পারছে না ব্যাংকটি। এ ছাড়া মোরশেদ খানের মালিকানাধীন বন্ধ হয়ে যাওয়া মোবাইল অপারেটর সিটিসেলের ঋণও খেলাপি হয়ে রয়েছে। এর ফলে ব্যাংকটির ঋণ থেকে যে সুদ আয় হচ্ছে, তা দিয়ে আমানতকারীদের সুদ পরিশোধ করতে পারছে না। গত জানুয়ারি-জুন সময়ে সুদ খাতে লোকসান হয়েছে ৪৩ কোটি টাকা। এই সময়ে ঋণ থেকে সুদ আয় হয়েছে ১ হাজার ২৯২ কোটি টাকা, তবে আমানতকারীদের সুদ দিতে হয়েছে ১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির শীর্ষ গ্রাহক তালিকায় ভালো প্রতিষ্ঠান নেই, তবে রয়েছে প্রভাবশালীরা।

এবি ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতে দেখা গেছে, গত ডিসেম্বরে তাদের কাছে মোট আমানত ছিল ৩৫ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা, যা জুনে কমে ৩৩ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকায় নেমে আসে। আর ডিসেম্বরে ঋণ ছিল ৩১ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা, যা জুনে কমে হয়েছে ৩১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। তবে খেলাপি ঋণ ৯ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৯ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকায় উঠেছে। যদিও প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি।

ব্যাংকে যোগ দেওয়ার আগে যেসব ঋণ খেলাপি ছিল, আমি শুধু তা হিসাবে যুক্ত করেছি। এর বাইরে আমার সময়ে দেওয়া কোনো ঋণ খেলাপি হয়নি। ব্যাংকের উন্নতি করতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
তারিক আফজাল, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এবি ব্যাংক  

আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০২৩ সালের শেষে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার প্রয়োজন ছিল ১০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি রাখতে পেরেছে মাত্র ২ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা। বাকি ৮ হাজার ৪১ কোটি টাকা চলতি বছরের মধ্যে রাখতে হবে।

নিরাপত্তা সঞ্চিতি মুনাফা থেকে সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকটির সুদ, সেবা ও বিনিয়োগ থেকে যে আয় হয়, তাতে ঘাটতি সঞ্চিতি রাখতে ৫ বছর সময় লাগবে।

ব্যাংকটি শুধু ঋণেই অনিয়ম করেনি, অফশোর ইউনিট থেকে দেওয়া ডলারের ঋণেও তা করেছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ব্যাংকটির অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে অর্থ পাচারের তথ্য উঠে আসে। অফশোর ইউনিট থেকে চার বিদেশি কোম্পানির নামে ৪ কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার বের করে নেওয়া হয়। ঋণের অর্থের একটি অংশ গেছে মোরশেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক মোটরসে। এই ঋণের বড় অংশই খেলাপি হয়ে গেছে।

২০১৮ সালে এবি ব্যাংকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হিসেবে নিয়োগ পান তারিক আফজাল। পরের বছরই তিনি পদোন্নতি পেয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হন। এরপর আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য হয়ে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ফলে এবি ব্যাংকের অনিয়ম ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নিশ্চুপ থাকে।

জানতে চাইলে তারিক আফজাল বলেন, ‘আমাকে জোর করে আওয়ামী লীগের একটি কমিটির সদস্য করা হয়েছিল। এতে আমার কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। আমি কখনো তাদের কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিইনি।’

তারিক আফজাল প্রথম আলোকে আরও বলেন, ‘ব্যাংকে যোগ দেওয়ার আগে যেসব ঋণ খেলাপি ছিল, আমি শুধু তা হিসাবে যুক্ত করেছি। এর বাইরে আমার সময়ে দেওয়া কোনো ঋণ খেলাপি হয়নি। ব্যাংকের উন্নতি করতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’