এবার এস আলমমুক্ত কমার্স ও আল-আরাফাহ্ ব্যাংক এবং আভিভা ফাইন্যান্স

— আমানতকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষায় এবং ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিতে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে।
— এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে কমার্স ব্যাংকের ১,৩১০ কোটি টাকা আটকা পড়েছে।

এস আলম গ্রুপের রাহুমুক্ত হয়েছে বেসরকারি খাতের আরও দুই ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও আল–আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক এবং আভিভা ফাইন্যান্স। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক এ তিন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আলাদা চিঠিতে তা জানিয়ে দিয়েছে।

আমানতকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করাসহ জনস্বার্থে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। পর্ষদ পুনর্গঠন করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই পাঁচজন করে পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যাঁদের মধ্য থেকে একজন করে নিয়োগ পেয়েছেন চেয়ারম্যান হিসেবে।

কমার্স ব্যাংক পরিস্থিতি

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক সরকারি ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০১৫ সালে এ ব্যাংকের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের হাতে। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ব্যাংকটিতে চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকও নিয়োগ দেয় এই গ্রুপ। তাদের মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আটকা পড়েছে ব্যাংকটির ১ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে তাদের মালিকানাধীন অন্য ব্যাংকগুলোয় ৬১০ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। এ ছাড়া এস আলম ও প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আটকে আছে বাকি ৭০০ কোটি টাকা। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও এসব টাকা ফেরত পাচ্ছে না কমার্স ব্যাংক। বেশির ভাগ বিনিয়োগ থেকে সুদও পাচ্ছে না। ব্যাংকটিতে প্রায় ৬০০ জনবল নিয়োগ দিয়েছে এস আলম গ্রুপ।

কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. আতাউর রহমানকে। পরিচালক নিযুক্ত হয়েছেন মেঘনা ব্যাংকের সাবেক অতিরিক্ত এমডি মো. মহসিন মিয়া, সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ শেখ আশ্বাফুজ্জামান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব কামরুল হক মারুফ ও জনতা ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি মরতুজা আহমেদ।

আল–আরাফাহ্ ব্যাংক

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নীরবে এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে যান আবদুস সামাদ। তিনি এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের (এস আলম) ভাই। এরপর ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসেন কেডিএস গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা খলিলুর রহমানের ছেলে সেলিম রহমান। ব্যাংকটির পরিচালক ছিলেন এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এম জাকারিয়া ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ওসমান আলী ও ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি আবদুল হামিদ মিয়া।

এই ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ তুলে নেয় এস আলম গ্রুপ। আবার এস আলমের মালিকানাধীন অন্য ব্যাংকে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে আটকে গেছে ব্যাংকটি। এতে আমানতকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে আল–আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান করা হয়েছে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি খাজা শাহরিয়ারকে। বাকি চার স্বতন্ত্র পরিচালক হলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. শাহীন উল ইসলাম, এনআরবি ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি মো. আবদুল ওয়াদুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক এম আবু ইউসুফ ও সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ মোহাম্মদ আশরাফুল হাছান।

নাজুক অবস্থায় আভিভা ফাইন্যান্স

বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার ছিলেন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি আর চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম। পি কে হালদারের মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটি একরকম লুট হয়ে যায়। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ শতাংশের ওপরে। পিকে হালদার পালিয়ে গেলে প্রতিষ্ঠানটি নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় আভিভা ফাইন্যান্স। তবে এটি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সম্প্রতি ব্যাংকগুলোকে এস আলমমুক্ত করার উদ্যোগ শুরু হলে আভিভা ফাইন্যান্স থেকে সরে যান সাইফুল আলম।

এমন পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে চেয়ারম্যান করা হয়েছে সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ মো. সদরুল হুদাকে। অন্য চার স্বতন্ত্র পরিচালক হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. গোলাম মোস্তফা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের চেয়ারম্যান এইচ এম মোশারফ হোসেন, অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি মো. রফিকুল ইসলাম ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সাবেক ডিএমডি আবু তাহের মোহাম্মদ আহমেদুর রহমান।

আভিভা ফাইন্যান্সে পাঠানো এক চিঠিতে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া পরিচালনা পর্ষদ গঠন, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিভিন্ন গ্রাহককে এক কোটি টাকার বেশি ঋণ অনুমোদন ও আর্থিক সূচকের অবনতি হওয়ায় আমানতকারীদের স্বার্থে পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা হলো।