আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে অরাজক প্রবণতা শুরু

ব্যাংকপ্রতীকী ছবি

নিয়মিত সরকারের অনুপস্থিতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার সুযোগ নিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অরাজক পরিস্থিতি তৈরির প্রবণতা শুরু হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, হুমকি-ধমকি, হট্টগোল, সমাবেশ হওয়া থেকে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বাদ যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন ডেপুটি গভর্নরসহ শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচ কর্মকর্তা কর্মকর্তা–কর্মচারীদের রোষানলে পড়ে গতকাল বুধবার সাদা কাগজে পদত্যাগপত্র লিখতে বাধ্য হন। যদিও এভাবে পদত্যাগ করা সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

এ ছাড়া কোথাও ভাঙচুর হয়েছে, এমনকি কোথাও মারধরও হয়েছে। কোথাওবা পুরোনো দাবি আদায়ে সংস্থার প্রধানকে তাঁরই কর্মীরা আটকে রাখেন। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কেউ আবার নতুন করে অর্থ আত্মসাতের পাঁয়তারাও করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জনরোষে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয় গত সোমবার। জানা গেছে, এরপর গত দুদিন অফিসে আসেননি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম মঙ্গলবার সকালে অফিসে এলেও বুধবার আসেননি। রাজস্ব বোর্ডের বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা গতকাল এক খোলাচিঠিতে বলেছেন, এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সব কর্মচারী-কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে চেয়ারম্যানের কাছে বিভিন্ন যৌক্তিক দাবি জানিয়ে ব্যর্থ হন। এনবিআরে কেন অন্য ক্যাডার থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিতে হবে, এটা তাঁদের মূল অসন্তোষের বিষয়।

অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার সচিবালয়ে আসার পথে ছিলেন মঙ্গলবার। কিন্তু আগুন লাগার খবর (আসলে গুজব) শুনে তিনি ফেরত যান। তবে গতকাল বুধবার পুরো অফিস করেছেন বলে প্রথম আলোকে জানান তিনি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আবদুর রহমান খান জানান, তিনি মঙ্গলবার ও বুধবার দুদিনই অফিস করেছেন।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী গতকাল বুধবার পুরোনো দাবি নিয়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আফজাল করিমকে কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখেন। তাঁদের দাবি বছরে ছয়টি বোনাস। এমডিকে আটকে রেখে গতকাল তাঁরা পাঁচটি বোনাসের দাবি আদায় করে ছাড়েন। গত জুনে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছয়টি বোনাসের দাবির কথা প্রথমে সোনালী ব্যাংককে জানান। সোনালী ব্যাংক অনুমোদনের জন্য তা পাঠায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তিনটি বোনাস দেওয়ার ব্যাপারে সম্মতও হয়েছিল।

* কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রোষে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিন ডেপুটি গভর্নরসহ শীর্ষস্থানীয় পাঁচ কর্মকর্তা সাদা কাগজে পদত্যাগপত্র লিখতে বাধ্য হন।
* সোনালী ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এমডি মো. আফজাল করিমকে আটকে রেখে বছরে পাঁচটি বোনাসের দাবি আদায় করেন।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংকেও অস্থিরতা শুরু হয়েছে। ঢাকার দিলকুশায় ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু কর্নার ভাঙচুর করেন একশ্রেণির বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা। পাশাপাশি মানবসম্পদ বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা মারধরের শিকার হন। বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ব্যাংকের সিবিএ নেতা আনিসুর রহমান গত মঙ্গলবার জানান, ২০১৭ সালের পরে যত নির্বাহী এসেছেন, তাঁরা আর ব্যাংকে ঢুকতে পারবেন না। যেভাবে ইসলামী ব্যাংক দখল হয়েছে, সেভাবেই আগের অবস্থা ফিরে আসবে।

এদিকে অনিয়ম, দুর্নীতি ও মালিকপক্ষের মাধ্যমে বেসরকারি খাতের সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে ১৮৮ কোটি আত্মসাৎ হয়েছে—এমন অভিযোগে কয়েক মাস আগেই কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এ কোম্পানি দুই মাস ধরে চলছিল আইডিআরএর নিয়োগ করা প্রশাসক এস এম ফেরদৌসের মাধ্যমে। অর্থ আত্মসাৎকারী গোষ্ঠীর পক্ষে সোনালী লাইফের কিছু কর্মচারী নতুন করে ৩২ কোটি টাকার চেকের অ্যাডভাইস দিতে প্রশাসকের বাসায় গিয়ে পর্যন্ত চাপ দিয়ে এসেছেন।

সোনালী লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান ও অন্যতম শেয়ারহোল্ডার মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তাঁর একান্ত সচিব পরিচয় দিয়ে মোশাররফ হোসেন নামের একজন জানান, মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস অসুস্থ। তাই কথা বলতে পারছেন না।

সোনালী ব্যাংকের এমডিকে যখন চাপ দিয়ে দাবি আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছিল, এই প্রতিবেদক তখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আবদুর রহমান খানের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে কথা বলছিলেন। সচিব প্রথম আলোকে বলেন, কোনোভাবেই তিনটার বেশি বোনাস তাঁরা পেতে পারেন না। ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করেছেন, আইনকানুন ছাড়া ব্যাংকের টাকা নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরির জন্য নয়। যা করা হয়েছে, তা অগ্রহণযোগ্য।

সোনালী লাইফের ব্যাপারে জানতে চাইলে আবদুর রহমান খান বলেন, ‘প্রশাসকের বাসায় গিয়ে ৩২ কোটি টাকার অ্যাডভাইস দেওয়ার চাপের একটা অভিযোগ পেয়েছি। কোম্পানিটির মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে আগেই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। নতুন করে কোনো চেষ্টা চললে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে একটা বিবৃতি দিয়ে এগুলো বন্ধ করার কথা বলা উচিত। সরকার গঠনের আগপর্যন্ত এভাবে দাবি আদায় করলে তা কার্যকর হবে না।