চৌধুরী নাফিজ সরাফাত: রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যাঁর উত্থান

২০০৯ সালে আ.লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। শুরুতে সখ্য  গড়ে ওঠে মহীউদ্দীন খান ও বেনজীরের সঙ্গে।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে ১৯৯৯ সালে চাকরিজীবন শুরু করেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। বিদেশি এ ব্যাংকে থাকার সময় হঠাৎ করেই বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হন তিনি। এক ব্যাংকে চাকরি আর অন্য ব্যাংকে পরিচালক—এমন প্রশ্ন ওঠার পর তিনি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দেন।

২০০৮ সালে তিনি যোগ দেন আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে। হন কনজ্যুমার ব্যাংকিংয়ের প্রধান। ভিজিটিং কার্ডে তিনি নিজের পরিচয় ‘এমডি, কনজ্যুমার ব্যাংকিং, আইসিবি গ্লোবাল হোল্ডিংস’ ব্যবহার করতেন।

তার আগেই চৌধুরী নাফিজ সরাফাত একটি মিউচুয়াল ফান্ডের লাইসেন্স নেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে। লাইসেন্সের জন্য প্রথমে নিজের নামে আবেদন করেছিলেন। যেহেতু ব্যক্তির নামে লাইসেন্স দেওয়া হয় না, তাই বিএসইসি সদস্য মোহাম্মদ আলী খানের পরামর্শে পরে তিনি কোম্পানি গঠন করেন। এ কোম্পানিরই নাম বাংলাদেশ রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট, যাতে তাঁর মালিকানা ২৫ শতাংশ। বাকি মালিকানা অন্য অংশীদার হাসান ইমামের। বিএসইসিতে তখন থেকে যাঁরা চাকরি করতেন, তাঁরা এসব তথ্য জানিয়েছেন, যা নিশ্চিত করেন নাফিজ সরাফাতও।

গোপালগঞ্জের মানুষ সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদকে ‘কাজিন’ হিসেবে অন্যদের কাছে পরিচয় দিতেন।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকেই বিভিন্ন খাতের অন্যতম প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন নাফিজ সরাফাত। শুরুতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েন। পরে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের সঙ্গে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্কের চিত্র গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। গোপালগঞ্জের এই ব্যক্তি শেখ হাসিনাকে ‘ফুফু’ বলে সম্বোধন করতেন। আর সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ছিলেন তাঁর ‘চাচা’। গোপালগঞ্জের মানুষ সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদকে ‘কাজিন’ হিসেবে অন্যদের কাছে পরিচয় দিতেন।

■ চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ছিলেন বিদেশি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। বাড়ি গোপালগঞ্জে। 

■ শেখ হাসিনাকে নাফিজ সরাফাত ‘ফুফু’ ডাকতেন, আ হ ম মুস্তফা কামালকে ডাকতেন ‘চাচা’।  

শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে নাফিজ সরাফাতের সম্পর্কের কথা ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের প্রায় সবারই জানা।

মাত্র ১৩ বছরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক, পুঁজিবাজার, বিদ্যুৎ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যমসহ আরও কিছু খাতে রহস্যজনক কিন্তু অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পান নাফিজ সরাফাত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, তিনি মালিক হন হাজার কোটি টাকার। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নাফিজ সরাফাতের সম্পদ অনুসন্ধান করতে দুদক তিন সদস্যের দল গঠন করেছে।

পুঁজিবাজার দিয়ে উত্থান

নাফিজ সরাফাত চেয়েছেন কিন্তু হয়নি, পুঁজিবাজারে এমন ঘটনা নেই বলে জানান বাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ইবিএল ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড দিয়ে রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের যাত্রা শুরু। বর্তমানে মেয়াদি ও অমেয়াদি মিলিয়ে রেসের ফান্ড রয়েছে ১৩টি।

১০টি ফান্ডের সর্বোচ্চ মেয়াদ ১০ বছর ছিল। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও এগুলোর অবসায়ন হয়নি, নাফিজ সরাফাতের তদবিরে বরং আরও ১০ বছর বেড়েছে। তখন বিএসইসির চেয়ারম্যান ছিলেন এম খায়রুল হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘তহবিলগুলোর মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব শুরুতেই আমি নাকচ করে দিয়েছিলাম। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তখন চিঠি দিয়ে বললেন, এটা
দেওয়া যায়। তখন দিতে হয়েছিল।’

মুষ্টিমেয় লোককে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে পুঁজি লুণ্ঠনের সুযোগ করে দেওয়া যে পদত্যাগী শেখ হাসিনা সরকারের বৈশিষ্ট্য, তা আমাদের পর্যবেক্ষণে এসেছে। নাফিজ সরাফাত তাঁদেরই একজন।
মইনুল ইসলাম, অর্থনীতিবিদ 

২০ আগস্ট সার্বিক বিষয়ে নাফিজ সরাফাতের সঙ্গে ফোনে এই প্রতিবেদকের কথা হয় প্রায় ৫০ মিনিট। তহবিলগুলোর মেয়াদ বৃদ্ধি সম্পর্কে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একবারে তহবিলগুলো অবসায়ন হলে বাজার থেকে টাকাগুলো উঠে যেত, যাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ত। তাই তিনি মেয়াদ বৃদ্ধির অনুমোদন নেন।

তিনি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ন্যাশনাল টি কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার পরিচালক নির্বাচিত হন ২০২১ সালে। গত ৩০ জুন শেষে রেস পরিচালিত তহবিলগুলোর ক্রয়মূল্যে সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যার বাজারমূল্য ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে গত জুন থেকে রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের তহবিলগুলোর ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত রয়েছে।

বেস্ট হোল্ডিংসকে সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে বাজারে আনার পাশাপাশি ছোট প্রতিষ্ঠান কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের আইপিও অনুমোদনেও তদবিরে নেমেছিলেন নাফিজ। কপারটেকের আর্থিক প্রতিবেদন তৈরিতে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠায় নিরীক্ষক আহমেদ অ্যান্ড আখতারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল তখন ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি)।

নাফিজ সরাফাত এফআরসিতে তদবির করতে এসেছিলেন জানিয়ে সংস্থাটির তৎকালীন চেয়ারম্যান সি কিউ কে মুসতাক আহমেদ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ কোম্পানির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি না হওয়া সত্ত্বেও তিনি কেন এসেছেন, জানতে চেয়েছিলাম। অন্য ধরনের কিছু থাকতে পারে, সন্দেহ হওয়ায় নাফিজ সরাফাতের তদবিরে সায় দিইনি।’ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তৎকালীন সচিব আসাদুল ইসলামও নাফিজ সরাফাতের পক্ষে তদবির করেছিলেন বলে জানান মুশতাক। 

কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির নামে ১৭১ কাঠার প্লট

কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান উপদেষ্টা সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ আরাফাত, যিনি পরে তথ্য প্রতিমন্ত্রী হন। ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১৭১ দশমিক ১৬ কাঠার একটি প্লট এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাদ্দ দেয় রাজউক। এতে সরকারের ক্ষতি হয় ৭৭ কোটি টাকা।

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের মূল নকশায় প্লটটি ছিল ‘সেকেন্ডারি স্কুল’। শ্রেণি পরিবর্তন করে ‘কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়’ করতে ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর নাফিজ সরাফাত আবেদন করলে রাজউকের পর্ষদ সভায় তা উপস্থাপিত হওয়ার পর ২৬ ডিসেম্বর অনুমোদন দেওয়া হয়।

গুলশানের ১০৩ নম্বর সড়কের একটি প্লটের মালিক নাফিজ সরাফাতের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা সাহিদ চৌধুরী। ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই এটিকে বাণিজ্যিক প্লট করার আবেদন করলে তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের হস্তক্ষেপে রাজউক এতে অনুমোদন দেয়। অথচ প্লটটি ‘বাণিজ্যিক ব্যবহারের আওতাভুক্ত নয়’ বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল রাজউক। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রাজউক অনুমতি দিয়ে বলেছে, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় এ অনুমতি দেওয়া হলো।

নাফিজ সরাফাত এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, লটারিতে অংশ নিয়েই ১৭১ কাঠার প্লট পেয়েছিলেন তাঁরা। আর এটা যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তাই আইনের লঙ্ঘন হয়নি। বাণিজ্যিক প্লটও আইন অনুযায়ীই হয়েছে।

এ কোম্পানির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি না হওয়া সত্ত্বেও তিনি কেন এসেছেন, জানতে চেয়েছিলাম। অন্য ধরনের কিছু থাকতে পারে, সন্দেহ হওয়ায় নাফিজ সরাফাতের তদবিরে সায় দিইনি।
এফআরসির তৎকালীন চেয়ারম্যান সি কিউ কে মুসতাক আহমেদ

ব্যাংক খাতে নাফিজ সরাফাত

রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১২ সালে ফারমার্স ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে। চার বছরে দুর্নীতির কারণে ব্যাংকটি মৃত্যুশয্যায় পৌঁছালে ২০১৭ সালের নভেম্বরে চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন তিনি। নতুন চেয়ারম্যান হয়ে আসেন নাফিজ সরাফাত। বিদেশি বিনিয়োগ আনার আশ্বাসে ব্যাংকটিকে অনেক নীতি ছাড় দেয় গভর্নর ফজলে কবিরের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ৭১৫ কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংকটির ৬৫ শতাংশ শেয়ার নেয় সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও আইসিবি।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ফারমার্সের নাম রাখা হয় পদ্মা। কিন্তু নাফিজের ছয় বছরে ব্যাংকটি আরও খারাপ হয়। খেলাপি ঋণ ৬২ শতাংশ। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংক ছেড়ে চলে যান তিনি। পদত্যাগী গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে দিয়ে এ ব্যাংককে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার ব্যবস্থা করেন নাফিজ সরাফাত।

নাফিজ সরাফাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ বেশি আছে। তবে আমি চেয়ারম্যান হওয়ার পর কেউ ঋণ পাননি। ব্যাংকটির ভালোর জন্যই একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।’

পদ্মা ব্যাংকের পর নাফিজ সরাফাতের নজর পড়ে সাউথইস্ট ব্যাংকের দিকে। ব্যাংকটির সাবেক দুই চেয়ারম্যান এম এ কাশেম ও আজিমুদ্দিন আহমেদকে কৌশলে পর্ষদ থেকে সরিয়ে দেন তিনি। সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়ে আসেন আলমগীর কবির। নাফিজ সরাফাতের স্ত্রী আনজুমান আরা সাহিদ হন পরিচালক। ছেলে চৌধুরী রাহিব সরাফাতকে ব্যাংকটির পরিচালক করতে চাইলেও অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে তা হয়নি।

বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেডের (বিআইএফএফএল) চেয়ারম্যান ছিলেন আব্দুর রউফ তালুকদার। বিআইএফএফএলের এমডি ফরমানুল ইসলামকে একদিন ডেকে নিয়ে তিনি কিছু ‘ভুল’ বিনিয়োগের জন্য চাপ দেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও নাফিজ সরাফাত সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

ফরমানুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজি না হওয়ায় বিআইএফএফএল থেকে আমাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।’ বেস্ট হোল্ডিংসের বন্ডেও বিআইএফএফএল থেকে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য নাফিজ সরাফাত চাপ দিয়েছিলেন বলে জানান তিনি।

খেলাপি ঋণ বেশি আছে। তবে আমি চেয়ারম্যান হওয়ার পর কেউ ঋণ পাননি। ব্যাংকটির ভালোর জন্যই একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
নাফিজ সরাফাত

গণমাধ্যম খাতে নাফিজ সরাফাত

অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডট কম এবং ২৫ বছর পর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে পুনরায় চালু হওয়া দৈনিক বাংলার নিয়ন্ত্রণ নাফিজ সরাফাতের। দুটির সঙ্গেই জড়িত এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। আর গণমাধ্যম দুটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নাফিজ সরাফাতের ভাই চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত।

নিউজবাংলা উদ্বোধনের দিনই নাফিজ সরাফাত টিভি চ্যানেল আনার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় তিনি টিভি আনার উদ্যোগ নেন, তা এখনো রহস্যাবৃত। ২০১৭ সালে সিটিজেন টিভি নামে একটি চ্যানেলের লাইসেন্স পেয়েছিলেন (এখনো সম্প্রচারে আসেনি) আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান।

শফিকুর রহমান গত ৩০ মে এক লিখিত অভিযোগে জানান, একদিন রাত ১২টার দিকে তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে ওয়েস্টিন হোটেলে নিয়ে যান এবং প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ার লিখে নেন নাফিজ সরাফাত। সঙ্গে ছিলেন পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদসহ আরও কয়েকজন। এটি ২০১৯ সালের ঘটনা। পরে তিনি জানতে পারেন, তাঁর নামে ৩০ শতাংশ, বেনজীর আহমেদের দুই মেয়ের নামে ৩০ শতাংশ, নাফিজ সরাফাতের নামে ২৫ শতাংশ এবং টুটুল নামের একজনের নামে ১৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাফিজ সরাফাত এ ঘটনাকে বানোয়াট বলে দাবি করেন।

নাফিজ পরিবারের কার কী সম্পদ

মিউচুয়াল ফান্ডগুলোয় মালিকানার পাশাপাশি নাফিজ সরাফাত আরগাস ক্রেডিট রেটিং সার্ভিসেসের চেয়ারম্যান। আর কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির পর্ষদে আছে তাঁর ভাই-বোন ও ছেলেমেয়ে। এ ছাড়া পদ্মা ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার ও ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ারের পরিচালক নাফিজ সরাফাত। পদ্মা ব্যাংকের গোপালগঞ্জ শাখাটি তাঁদের পারিবারিক ভবন। ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, গ্রিন রোড, গুলশান, বারিধারা ও নিকুঞ্জে নাফিজ, তাঁর স্ত্রী ও ভাইয়ের নামে আটটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর বাইরে কানাডায় একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা গেছে।

কানাডা বাংলাদেশ চেম্বার হাউসের (কানাডা) সভাপতি, কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব ও আর্মি গলফ ক্লাবের সদস্য, ওয়ার্ল্ড চেজ ফেডারেশনের (বাংলাদেশ বিভাগ) সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য তিনি।

নাফিজ সরাফাত বলেন, তিনি খুব পরিশ্রমী। ৮০ বছরের পরিশ্রম যোগ করলে যা হয়, তা তিনি করেছেন ৫০ বছর বয়সে। আর যাঁদের সঙ্গে সখ্যের কথা বলা হচ্ছে, ব্যবসা করতে করতেই তা হয়েছে।

শফিকুর রহমান গত ৩০ মে এক লিখিত অভিযোগে জানান, একদিন রাত ১২টার দিকে তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে ওয়েস্টিন হোটেলে নিয়ে যান এবং প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ার লিখে নেন নাফিজ সরাফাত।

লেখক মুশতাকের মৃত্যু, নেপথ্যে কী

নাফিজ সরাফাত পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়ে আসার পর একটি কার্টুন আঁকেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। নাফিজ সরাফাতকে চিত্রায়িত করা ওই কার্টুনে নাভির জায়গায় দেখা যায় ব্যাংকের প্রতীক সিন্দুকের হাতল। তাতে ক্যাপশন ছিল, ‘আমি চৌ নাফিজ সরাফাত/ জানি ব্যাংক খাওয়ার ধারাপাত!’ ২০২০ সালের ২ মে কার্টুনিস্ট কিশোর ও ৪ মে কার্টুনের ক্যাপশন লেখক মুশতাক আহমেদকে তুলে নেওয়া হয়।

৫ মে গ্রেপ্তার দেখানোর পর ১০ মাসে ছয়বার তাঁদের জামিনের আবেদন নাকচ হয়। ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কাশিমপুর কারাগারে মারা যান মুশতাক আহমেদ। পরের মাসে জামিন পান কিশোর। এরপর গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কিশোর বলেছিলেন, নির্যাতনের সময় একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে নিয়ে কার্টুন আঁকার বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল।

দুজনকে নির্যাতনের পেছনে আপনার দায় আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে নাফিজ সরাফাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁদের কাউকেই চিনতাম না। কার্টুন আঁকা হয়েছে অনেককে নিয়ে, আমাকে নিয়ে ছিল একটা। সংস্থার লোকেরা অতি উৎসাহী হয়ে কাজটি করতে পারে।’

‘আমি চৌ নাফিজ সরাফাত/ জানি ব্যাংক খাওয়ার ধারাপাত!’ ২০২০ সালের ২ মে কার্টুনিস্ট কিশোর ও ৪ মে কার্টুনের ক্যাপশন লেখক মুশতাক আহমেদকে তুলে নেওয়া হয়।

সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুষ্টিমেয় লোককে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে পুঁজি লুণ্ঠনের সুযোগ করে দেওয়া যে পদত্যাগী শেখ হাসিনা সরকারের বৈশিষ্ট্য, তা আমাদের পর্যবেক্ষণে এসেছে। নাফিজ সরাফাত তাঁদেরই একজন। এসব লুণ্ঠনকারীর কাছ থেকে যে সুবিধা নিয়েছেন শেখ হাসিনার আত্মীয়স্বজন, তা অনুমান করা যায়।’

মইনুল ইসলাম আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হবে নাফিজ সরাফাতসহ এ ধরনের সবার ব্যাপারে যথাযথভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া।