ঋণ পরিশোধ
ব্যাংকমালিকদের নতুন আবদার
মেয়াদি ঋণের মেয়াদ আরও তিন বছর বৃদ্ধি এবং চলতি মূলধন ও তলবি ঋণকে মেয়াদি ঋণে পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন ব্যাংকমালিকেরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত ব্যাংকের এমডিরা মেনে নিলেও মালিকেরা তুলছেন নতুন দাবি।
পোশাকমালিকেরাও ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময় চেয়েছেন।
দেশের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাব বিবেচনা করে ঋণ পরিশোধে ২০২০ সালজুড়ে ছাড় দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ঋণ শোধ না করলেও কেউ খেলাপি হয়নি। নতুন বছরে এ সুবিধা বহাল রাখেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে মেয়াদি ঋণের যে মেয়াদ বাকি আছে, তা পরিশোধের সময় সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বা দুই বছর পর্যন্ত বাড়ানোর সুযোগ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা।
এখন ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) দাবি করেছে, দেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসমূহ এখনো করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পোশাক কারখানাগুলোর ক্রয়াদেশ ৩০-৪০ শতাংশ কমেছে। এ জন্য মেয়াদি ঋণের মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি চলতি মূলধন ও তলবি ঋণের পরিশোধযোগ্য অংশকে মেয়াদি ঋণ হিসেবে পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। এ ছাড়া বিএবি কোনো ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন জমা ছাড়াই কমপক্ষে তিন বছরে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে।
এসব নিয়ে বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরকে একটি চিঠি দেন। এর আগে বিএবির চাপে সরকার যেমন ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তনসহ নানা সুবিধা দিয়েছিল, তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিভিন্ন নীতিকৌশলে পরিবর্তন করেছিল।
জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ঋণের ৬০ শতাংশের বেশি চলতি মূলধন ঋণ। এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া এখনো করোনা শেষ হয়নি। বৈশ্বিক চাহিদাও আগের অবস্থায় ফেরেনি। তাই চলতি মূলধন ঋণকে মেয়াদি ঋণে পুনর্গঠনের দাবি জানানো হয়েছে। ঋণের মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়ানোর জন্য বলা হয়েছে।
ব্যাংকের এমডিরা যে সিদ্ধান্তে ধন্যবাদ জানান, আপনারা সেখানে নতুন দাবি তুলছেন কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরাও ব্যবসায়ী। আমরা জানি পুরো ঋণ শোধের মতো অবস্থা এখনো আসেনি। এ ছাড়া পোশাকমালিকেরাও এ দাবি তুলেছেন। ঋণ শোধ না হলে ব্যাংকগুলো বিপদে পড়বে। এর চাপ পুরো অর্থনীতিতে পড়বে।’
এদিকে ব্যাংক কর্মকর্তাদের একটি অংশ বলছেন, ২০২০ সালে যাঁরা চলতি মূলধন ঋণের কিস্তি দেননি, তাঁদের এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী পুরো টাকাই পরিশোধ করতে হবে। এতে গত বছরের চার কিস্তি ও সুদের টাকা দিতে হবে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত রোববার এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, ২০২০ সালে সব ধরনের ঋণ শ্রেণীকরণে বিলম্ব সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, যা গত পয়লা জানুয়ারি থেকে আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এখন মেয়াদি ঋণের অবশিষ্ট মেয়াদের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সময় বাড়ানো যাবে। আর বর্ধিত সময়সীমা কোনোভাবেই দুই বছরের বেশি হবে না।
বিএবির চিঠিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ৫০ শতাংশ বা কোনোটি তারও কম উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারছে। করোনার নেতিবাচক প্রভাবে ভোগ্যপণ্যের স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্যয় ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর গড় বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বিএবি বলেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মেয়াদি ঋণের অবশিষ্ট মেয়াদের ৫০ শতাংশ বা দুই বছর অতিরিক্ত সময় বাড়ানোর সুযোগ দিয়েছে। এতে যেসব ঋণের মেয়াদের পরিমাণ বেশি, তারা কিছুটা সুবিধা পাবে। কিন্তু যাদের অবশিষ্ট মেয়াদ খুবই কম, তাদের কম সময়ে বড় অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যা খুবই দুষ্কর হবে। এতে ঋণের বড় অংশ অনিচ্ছাকৃত খেলাপিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নগদ টাকা প্রবাহ বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে কমপক্ষে আরও তিন বছর বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
বিএবি বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি মূলধন ও তলবি ঋণ সম্পর্কে কিছুই বলেনি, যা এক বছরের মধ্যে পরিশোধযোগ্য ঋণ। এতে মোট ঋণের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ নির্দেশনার বাইরে রয়ে গেছে। তাই ২০২০ সালের সব কিস্তি ও সুদ এখনই শোধ না হলে চলতি বছরের জানুয়ারিতেই এসব ঋণ খেলাপি হয়ে যেতে পারে। এতে ব্যবসায়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে। সে জন্য চলতি মূলধন ও তলবি ঋণের পরিশোধযোগ্য অংশ কোনো জমা ছাড়াই মেয়াদি ঋণ হিসেবে তিন বছরে পরিশোধের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়েছে বিএবি।
বর্তমান নিয়মে চলতি মূলধন ঋণকে মেয়াদি ঋণে পরিণত করতে এর বিপরীতে স্থায়ী সম্পদ থাকতে হয়। এ ছাড়া খেলাপি হলে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত এককালীন জমা দিতে হয়।
এদিকে গত সোমবার পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক এক চিঠিতে বিএবিকে জানান, করোনার কারণে অনেক ক্রেতা দেউলিয়া হয়ে পড়েছেন। এতে তাঁদের মূল্য পরিশোধ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া নতুন রপ্তানি আদেশও আসছে না। এতে তারল্যসংকট তৈরি হয়েছে। তাই ঋণ শোধে বাড়তি সময় দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে গত বছর শোধ করা হয়েছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বিশেষ সুবিধা পেয়েও তা কাজে লাগাননি অনেক ব্যবসায়ী। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমে হয়েছে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ।