হাতের তাঁত টিকবে কি?
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের নোয়াপাড়ার তাঁত ব্যবসায়ী মুছা প্রধান। পূর্বপুরুষের ব্যবসা ধরে রেখেছেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম মেসার্স ফাহিম জামদানি ঘর। তিনি আর এই হস্তচালিত তাঁত ব্যবসায় থাকতে চাচ্ছেন না। কারণ, এখন আর জামদানি শাড়ি বানিয়ে খরচে পোষাতে পারেন না তিনি। বিক্রিবাট্টাও ভালো নয়। অন্য ব্যবসার সন্ধানে আছেন তিনি।
হস্তচালিত তাঁতশুমারি ২০১৮–এর প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর পরিসংখ্যান ভবনে আসেন মুছা প্রধান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উদ্যোগে এই তাঁতশুমারি হয়। অনুষ্ঠান শেষে সেখানেই তাঁর সঙ্গে কথা হয় গতকাল বিকেলে। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে পরিসংখ্যান ভবনের মিলনায়তনের মূল দরজার সামনে নিজের বানানো কিছু তাঁতের শাড়ি প্রদর্শন করেন তিনি।
এই প্রতিবেদককে একটি সবুজ রঙের শাড়ি দেখিয়ে মুছা প্রধান মলিন মুখে জানান, এটি বানাতে কারিগরকে দিতে হয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা। শাড়ির সুতা, রংসহ কাঁচামালে খরচ গেছে আরও ৮০০ টাকা। আর কারিগরের সহকারীর পেছনে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে শাড়িটি বানাতে ৩ হাজার ৮০০ টাকা খরচ হয়েছে। এ ধরনের একটি শাড়ি সাড়ে চার হাজার টাকার ওপরে বিক্রি করা সম্ভব নয়। তাই এত পরিশ্রম করেও মুনাফা খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে না।
মুছা প্রধানের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, হস্তচালিত তাঁতের কারিগরেরা এখন আর এই পেশায় থাকতে চাচ্ছেন না। মুছা প্রধানের একজন কারিগর সম্প্রতি এই পেশা ছেড়ে দিয়ে অটোরিকশা চালাতে শুরু করেছেন। সেখানে আয় ভালো। অনেকেই তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকের কাজে নেমে পড়েছেন। হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
সার্বিকভাবে হস্তচালিত তাঁতের দুর্দিনের এমন চিত্র উঠে এসেছে মুছা প্রধানের কথায়। এমন অবস্থায় তাঁতশিল্প টিকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন খোদ পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তাঁতশুমারির প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানেই তিনি এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
রাষ্ট্রের অন্যতম এই নীতিনির্ধারক বলেন, এই তাঁত আরও সংকুচিত হবে। এটা আবেগের বিষয় নয়, যান্ত্রিকীকরণের ফলে এটা হচ্ছে। শেষ বিচারে তাঁতশিল্প টিকবে কি না সন্দেহ আছে। বস্ত্র খাতে তাঁতের ভূমিকা আগের মতো থাকবে কি না, সন্দেহ আছে তা নিয়েও।’
বিবিএসের হস্তচালিত তাঁতশুমারির ফলাফলেও এই খাতের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার চিত্র উঠে এসেছে। বিবিএস বলছে, ১৯৯০ সালে নরসিংদী জেলায় সবচেয়ে বেশি ২০ হাজারের মতো তাঁত ছিল। গত ২৮ বছরে কমতে কমতে টিকে আছে মাত্র ১ হাজার ১২৮টি তাঁত।
এবার আসা যাক সার্বিকভাবে দেশের তাঁতশিল্পের কী অবস্থা, সে বিষয়ে। বিবিএসের শুমারির ফলাফল অনুযায়ী, সারা দেশে এখন কারখানা ও গৃহস্থালি পর্যায়ে মোট ১ লাখ ১৬ হাজার ৬টি তাঁত সচল আছে। ১৯৯০ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৪২১। প্রায় তিন দশকে অর্ধেক তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে।
আবার গত তিন দশকে তাঁতকে কেন্দ্র করে পেশাজীবীর সংখ্যাও ব্যাপক হারে কমেছে। ১৯৯০ সালে এই শিল্পে প্রায় ১০ লাখ ২৭ হাজারের বেশি লোক নিয়োজিত ছিলেন। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১ হাজার ৭৫৭ জনে। মাত্র ১৫ বছরেই দেশের ৯৫ শতাংশ হস্তচালিত তাঁত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
কেন তাঁতশিল্পের এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা—এর কয়েকটি কারণও বলেছে বিবিএস। বিবিএস বলেছে, তাঁত পেশায় আয় কম, হস্তশিল্প থেকে যান্ত্রিক শিল্পের পরিবর্তন, পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব, তাঁতশিল্পে শ্রমিকের অভাব, তাঁতপণ্যের বাজারজাত করার সমস্যা ইত্যাদি।
হস্তচালিত তাঁতের জন্য একসময় বিখ্যাত ছিল নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইলের মতো জেলাগুলো। শিল্পায়নের ধাক্কায় এসব জেলায় তাঁত টিকতে পারছে না। ফলে সেই ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আর সমতল ছেড়ে তাঁত জায়গা নিয়েছে পাহাড়ে। তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে দেশের এখন ৫৫ শতাংশ তাঁত আছে। এসব জেলায় দেশের এক-তৃতীয়াংশ বা ৯৪ হাজার ১৯৭ জন হস্তচালিত তাঁতি আছেন। দেশের ৯২ শতাংশ বা ১ লাখ ৭ হাজারের মতো তাঁত আছে মাত্র ১৫টি জেলায়।
তবে এত দুঃসংবাদের মধ্যে ভালো খবরও আছে। তাঁতশিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। এই শিল্পের ৫৬ শতাংশ বা ১ লাখ ৬৮ হাজার শ্রমিকই নারী। ১৫ বছর আগেও এই শিল্পে ৪৬ শতাংশ নারী ছিলেন।
বিবিএসের অনুষ্ঠানে তাঁতশুমারির প্রাথমিক ফলাফল তুলে ধরেন প্রকল্প পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ। তাঁতশুমারি প্রাথমিক ফলাফলের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের প্রতিবেদনটি ইংরেজি ভাষায় লেখার সমালোচনা করেন প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, ‘কাজ করলেন বাংলায়, খাইলেন বাংলায়, কিন্তু লিখলেন ইংরেজিতে। প্রতিবেদনটি বাংলায় হলে বেশি কাজে লাগত। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হলে এই ধরনের প্রতিবেদন বাংলায় লেখা উচিত।’
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী বলেন, পোশাকশিল্পসহ অন্য খাতে পুঁজির বিকাশের ফলে তাঁতশিল্পের নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিবিএসের মহাপরিচালক কৃষ্ণা গায়েন।