২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সময় এসেছে আর্থিক অনিয়মের বিরুদ্ধে ঝাঁকুনি দেওয়ার

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

আর্থিক খাতের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঝাঁকুনি দেওয়ার সময় এসেছে বলে মনে করেন সংস্থাটির সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেছেন, তদন্ত প্রতিবেদন ড্রয়ারে ঢুকলেই দুর্নীতি শুরু হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেছেন, যখনই কোনো নালিশ আসবে, যেদিন আসবে, সেদিনই তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। যখন কোনো তদন্ত প্রতিবেদন ড্রয়ারে ঢুকে যায়, তখন দুর্নীতির প্রবাহ শুরু হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সময় এসেছে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার, শক (ঝাঁকুনি) দেওয়ার।

‘পাঁচ দশকের উন্নয়ন অভিযাত্রায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক’ শিরোনামে দ্বিতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলনে রেকর্ড করা ভিডিও বার্তায় সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন এসব কথা বলেন।

সিটি ব্যাংকের সহযোগিতায় দৈনিক বণিক বার্তা গতকাল বুধবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এই সম্মেলনের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে দুজন সাবেক গভর্নর ও বর্তমান গভর্নর সশরীর উপস্থিত ছিলেন। বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য দেন সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসরুর আরেফিন।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত পাঁচ দশকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রার মান ধরে রাখা, বৈদেশিক বাণিজ্য ও ব্যাংক খাতের তদারকি ভালোভাবে করেছে মন্তব্য করে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এবং এর সামাজিক রূপান্তর ও সামগ্রিক উন্নয়নে যে কয়েকটি বিশিষ্ট অংশীদার রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক অন্যতম। চড়াই-উতরাই গেলেও অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে পুরো বিষয়টি এগিয়ে নিতে পেরেছে।

অর্থ পাচার বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, সরকার যদি চায় তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক, কাস্টমস ও সিভিল এভিয়েশন অথরিটি সম্মিলিতভাবে কাজ করে অর্থ পাচার বন্ধ করা সম্ভব। খেলাপি ঋণ বিষয়ে সাবেক এই গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ ও ২০১৪ সালে ইচ্ছাকৃত শীর্ষ-১০ খেলাপি গ্রাহককে বিশেষ সুযোগ দেয়। এ জন্য রাষ্ট্রকে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, ব্যাংক ব্যবস্থায় বড় সমস্যা হচ্ছে, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অনেকে বড় অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। তাতে যেটি হয়, ব্যাংক নতুন করে অতিরিক্ত আমানত না পেলে গ্রাহকদের ঋণ দিতে পারে না। ফলে খেলাপি ঋণ একটি সামাজিক অপরাধ।

আর্থিক খাতের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আমরা স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। সেটির সঙ্গে আর্থিক খাতকে দক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। শুধু জিডিপিতে জোর দিলে হবে না। আর্থিক খাত দক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য না হলে বৈশ্বিক অস্থিতিশীল আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে না।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ নিজের মেয়াদকালে বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের চাপের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা কৌশল করে সেই চাপ এড়িয়েছি।’

হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ সরকারি ব্যাংকগুলোকে একটি ব্যাংকে পরিণত করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, রাজনৈতিক কারণে সরকারি ব্যাংকগুলোকে অনেক ঋণ দিতে হয়। ব্যাংকের সংখ্যা কমানো গেলে খেলাপি ঋণও কমিয়ে আনা সম্ভব।

অনুষ্ঠানের শুরুতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। প্রতিষ্ঠার পর গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামগ্রিক কার্যক্রম ও অর্জনের কথা তুলে ধরেন তিনি।

জ্যেষ্ঠ অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, গত এক দশকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় অর্জন ডিজিটালাইজেশন।

সাবেক দুই গভর্নরের দুই মত

সম্মেলনে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখার বিষয়ে সাবেক দুই গভর্নর ভিন্নমত পোষণ করেন। মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমদানির জন্য ডলারের কম দাম, সাধারণ রপ্তানির ওপর ১ শতাংশ প্রণোদনা আর প্রবাসী আয়ে ২ শতাংশ প্রণোদনা—এগুলো অর্থনীতি শাস্ত্রে সমর্থন করে না। কোনো দেশের অর্থনীতির অভিজ্ঞতাও এগুলোকে উৎসাহিত করে না। এসব না করে যাঁরা জানেন-বোঝেন, তাঁদের দিয়ে এক-দুই মাসের মধ্যে সমীক্ষা করে প্রয়োজনে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ২-৪ শতাংশ অবমূল্যায়ন করলে বর্তমানের চেয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে। কারণ, আমদানি ভীষণভাবে বাড়ছে। অন্যদিকে প্রবাসী আয় গত ছয় মাসে ৪০০-৫০০ কোটি ডলার কমে গেছে। আমি চিত্রটা ভালো দেখছি না।’

অন্যদিকে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, সাম্প্রতিককালে মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর চাপ বেড়েছে। কারণ, গত পাঁচ মাসে হঠাৎ আমদানি ৫৪ শতাংশ বেড়েছে। আশার কথা, মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি ৩০ শতাংশ এবং কাঁচামালের আমদানি বেড়েছে প্রায় শতভাগ। এগুলো বিনিয়োগবান্ধব। সাময়িক এই চাপ থেকে উত্তরণে প্রবাসী আয়ের ওপর প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করার প্রস্তাব দেন তিনি। একই সঙ্গে প্রবাসীদের জন্য যেসব বন্ড রয়েছে, সেগুলোর সুদ কমিয়ে হলেও প্রত্যেক বিনিয়োগকারীকে ১ কোটি টাকা বেশি কেনার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এতে দেশে ডলারের সরবরাহ বাড়বে।