২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

শ্রমিকদের দায়িত্ব নেননি তাঁরা

  • শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ হয়নি, থেমে থেমে চলছে। সে কারণে পোশাকশ্রমিকেরা সারাক্ষণই চাকরি হারানোর ভয়ে থাকেন।

  • করোনাকালে শ্রমিকদের সঙ্গে যা যা হয়েছে, তা দিয়ে পোশাকশিল্পকে টেকসই করা যাবে না।

শ্রমিকদের সস্তা শ্রমের পিঠে চড়েই রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছে। অথচ করোনাভাইরাস মহামারির সময় শ্রমিকদের কথা চিন্তা করেনি তারা। দায়িত্বও নেয়নি। শ্রমিকদের পুঁজি করে সরকারের কাছ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা নেওয়ার পরও গণহারে শ্রমিক ছাঁটাই, মজুরি ও বোনাস কম দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলেও তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ তাদের সদস্যদের কারখানা বন্ধ রাখার অনুরোধ করে। যদিও অনেক কারখানার মালিকই সেটি মানেননি। পরে লকডাউনের মধ্যেই হঠাৎ কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যানবাহন বন্ধ থাকলেও দূরদূরান্ত থেকে হেঁটে, রিকশা-ভ্যান-পিকআপে চড়ে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিতে আসেন। শ্রমিকদের করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আর অবর্ণনীয় দুর্ভোগের চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। তখন কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয় এবং বাড়ি ফিরতে আবারও হয়রানির মুখে পড়েন শ্রমিকেরা। মূলত কারখানার মালিকদের পাশাপাশি শ্রম ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তহীনতা ও সমন্বয়হীনতার কারণেই এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে লাখ লাখ পোশাকশ্রমিককে এই অমানবিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল।

মার্চের শুরুর দিকে বিদেশি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে পোশাকের কার্যাদেশ বাতিল করতে থাকে। অন্যদিকে লকডাউন শুরুর পর সরকারের আদেশ অমান্য করে তাদের একের পর এক কারখানা লে-অফ হতে থাকে। সাধারণ ছুটি হলে শ্রমিকেরা পূর্ণ মজুরি পান। তবে লে-অফ করলে মূল মজুরির অর্ধেক ও বাড়িভাড়া দিলেই চলে। মালিকেরা সেই সুবিধাই নিতে চেয়েছেন। অথচ এর আগেই প্রধানমন্ত্রী পোশাকশ্রমিকদের তিন মাসের মজুরি দেওয়ার জন্য নামমাত্র সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করেন। পরে সেই তহবিলের আকার বৃদ্ধি করা হয়। শেষ পর্যন্ত মালিকেরা তহবিল থেকে ঋণ নিয়েই চার মাসের মজুরি দেন। তবে শর্তের বেড়াজালে ছোট কারখানাগুলো ঋণ পায়নি। সেই কারখানার শ্রমিকেরাও মজুরি পাননি। অন্যদিকে যেসব প্রতিষ্ঠান সচ্ছল, যাদের অর্থের প্রয়োজন নেই, তারা স্বল্প সুদে তহবিলের ঋণ নিয়েছে।

সরকারের তহবিল থেকে ঋণ পেলেও মালিকেরা মজুরি কম দেওয়ার কৌশল করেন। এপ্রিলে তিন সপ্তাহ কারখানা বন্ধের অজুহাত দেখিয়ে ৬০ শতাংশ মজুরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শ্রমিকনেতারা বিরোধিতা করলে পরে মজুরি আরও ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। রোজার ঈদে বোনাসও কম পান শ্রমিকেরা। তাতে সংসার চালানো দুর্বিষহ হয়ে পড়ে শ্রমিকদের। কারণ, পোশাকশ্রমিকেরা যে মজুরি পান, তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। পরিবারের অন্য সদস্যের আয় ভাগাভাগি করে তাঁরা সংসার চালান। করোনাকালে সেই সদস্যের আয়–রোজগার প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে পোশাক তৈরি করছেন শ্রমিকেরা। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের প্লামি ফ্যাশনসে।
ছবি: প্রথম আলো

করোনাকালে শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকদের ব্যবহার ছিল অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য। এই সময়েই সবচেয়ে বেশি শ্রম আইন ও বিধিমালার লঙ্ঘনও করেছেন তাঁরা। সরকারের তরফ থেকে শ্রমিক ছাঁটাই না করার নির্দেশ ও অনুরোধ থাকলেও কারখানার মালিকেরা চাকরির বয়স এক বছরের কম, এমন শ্রমিকদের ঢালাওভাবে ছাঁটাই করেছেন। কোনো কোনো কারখানা কর্তৃপক্ষ জোর করে স্বাক্ষর নিয়ে শ্রমিকদের চাকরি থেকে বের করে দিয়েছে। মাতৃত্বকালীন ছুটির প্রয়োজন, এমন নারী শ্রমিকদের বাদ দেওয়া হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের বেছে বেছে ছাঁটাই করা হয়েছে। গত ছয় মাসে যেসব শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন, তাঁদের প্রতি ১০ জনের ১ জন নতুন কারখানায় যোগ দিতে পেরেছেন। বাকিরা ফিরে গেছেন সেখানে, যেখান থেকে তাঁরা শুরু করেছিলেন। এই ফিরে যাওয়া শ্রমিকদের বেশির ভাগই নারী।

শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ হয়নি, থেমে থেমে চলছে। সে কারণে পোশাকশ্রমিকেরা সারাক্ষণই চাকরি হারানোর ভয়ে থাকেন। প্রতিটি কারখানা ক্রয়াদেশ কম থাকার অজুহাতে শ্রমিকসংখ্যা কয়েক শতাংশ কমিয়েছে। কথায় কথায় চাকরি যাচ্ছে। নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দিলেও সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। ইউনিয়নে যোগ দিলে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের মারধর ও ছাঁটাইয়ের অভিযোগ আসছে। শ্রমিকেরা এই অন্যায্য আচরণের শিকার হয়েও মুখ বুজে সয়ে যাচ্ছেন। কারণ, চাকরি নেই মানে মজুরি নেই, আর মজুরি নেই মানে ঘরে খাবার নেই।

করোনাকালে শ্রমিকদের সঙ্গে যা যা হয়েছে, তা দিয়ে পোশাকশিল্পকে টেকসই করা যাবে না। সে জন্য শ্রমিকদের ঘিরে উন্নয়নের পরিকল্পনা করতে হবে। শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিতে মনোযোগ দিতে হবে। শ্রমিকদের বাঁচার মতো প্রয়োজনীয় মজুরি বা লিভিং ওয়েজের ব্যবস্থার পাশাপাশি তাঁদের জন্য সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা চালু করা দরকার। স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দিতে অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। ক্রেতাদের ব্যবসা নীতিমালা নতুন করে প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।