শেখ আবদুল হাই ধরা পড়বেন কবে
গোপনে মতিঝিলে গড়ে উঠেছিল একাধিক ক্যাসিনো। রাজনৈতিক প্রভাবশালী কিছু মানুষ সেগুলো চালাতেন, অনেক মানুষ প্রকাশ্যে সেখানে জুয়া খেলতে যেতেন। এতে কিছু মানুষ যে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানেই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এই মতিঝিলেই সাধারণ মানুষের অর্থ নিয়ে জুয়া খেলার ঘটনা তো আরও অনেক আছে।
এই যেমন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু। সরকারি খাতের একসময়ের সবচেয়ে ভালো ব্যাংক ছিল এটি। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত নিয়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন শেখ আবদুল হাই। এর চেয়ে বড় জুয়া আর কী আছে। আর এ কারণেই হয়তো ক্যাসিনো-কাণ্ডের মূল হোতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের নামের সঙ্গে শেখ আবদুল হাইয়ের প্রসঙ্গটিও চলে এসেছে।
শেখ ফজলে নূর তাপস বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্যসচিব ও সাংসদ। গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে কিছু প্রশ্ন তোলেন তিনি। এর একটি হচ্ছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও কেন এখন পর্যন্ত সম্রাটকে আটক করা হয়নি?’ আরেকটি হচ্ছে, ‘বেসিক ব্যাংককে ডুবিয়েছেন আবদুল হাই বাচ্চু। আজ পর্যন্ত কেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেনি, তাঁকে আটক করেনি?’
শেখ ফজলে নূর তাপসের এ বক্তব্যের পরদিন ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট ধরা পড়লেন, এবার শেখ আবদুল হাই ধরা পড়বেন কবে? কদিন আগেও যাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে মনে করা হয়েছিল, তাঁদের বেশ কয়েকজন ইতিমধ্যে আটক হয়েছেন, জেলে গেছেন, অনেকের অর্থের সন্ধানও শুরু হয়ে গেছে। তাহলে কি তাঁদের সবার চেয়ে ক্ষমতাধর আবদুল হাই?
ক্যাসিনো-কাণ্ডের শুরুতে যাঁদের ধরা হলো, তাঁদের কেউ আগে বিএনপি করতেন, কেউ অন্য দল। নানা স্বার্থে পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। সম্রাট অবশ্য দলেরই নেতা। কিন্তু আবদুল হাই তো কখনোই দলের কেউ ছিলেন না। তিনি জাতীয় পার্টি করতেন। এরশাদ আমলে বাগেরহাট-মোল্লাহাট থেকে একবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাহলে তাঁর শক্তির উৎস কী? সম্ভবত এর উত্তর দুদক দিতে পারবে। কারণ, কোন অদৃশ্য শক্তির কারণে শেখ আবদুল হাইয়ের কোনো দোষ খুঁজে পেল না তারা, তা কেবল দুদকেরই জানা।
এমন নয় যে শেখ আবদুল হাই নিয়ে এবারই প্রথম কেউ প্রশ্ন তুললেন। মূলত বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল ২০১২ সাল থেকেই। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম দফায় আবদুল হাইকে তিন বছরের জন্য এবং ২০১২ সালে আরও দুই বছরের জন্য বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়। ২০১৩ সালের ১১ জুলাই বেসিক ব্যাংকের পরিচালক, সাবেক যুগ্ম সচিব এ কে এম রেজাউর রহমান ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে দেওয়া একটি চিঠিতে তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কাউকে পরোয়া করেন না তিনি। কার্যত ব্যাংকটি চলে চেয়ারম্যানের নির্দেশে। তিনি লোকবল নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতি, সব ক্ষেত্রেই একচ্ছত্র প্রভাব রাখেন।’
এরপর বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম, জালিয়াতি ও দুর্নীতি নিয়ে ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চিঠিতে বলা ছিল, ‘ব্যাংকের ঋণশৃঙ্খলা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। প্রধান কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটি বিরোধিতা করলেও বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ঋণ অনুমোদন করে দেয়। ৪০টি দেশীয় তফসিলি ব্যাংকের কোনোটির ক্ষেত্রেই পর্ষদ কর্তৃক এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় না।’
ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হতে থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালের ২৯ মে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে সরকারের কাছে সুপারিশ করে। তারপরও সরকার আবদুল হাইকে অপসারণ না ২০১৪ সালের ৬ জুলাই তাঁকে পদত্যাগের সুযোগ করে দেয়। এরপর থেকেই বহাল তবিয়তে আছেন শেখ আবদুল হাই।
সে সময়ে অর্থমন্ত্রী ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি শেখ আবদুল হাইকে নিয়ে কথা বলা শুরু করেন ২০১৫ সাল থেকে। ওই বছরের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী হল-মার্ক কেলেঙ্কারি ও বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি নিয়ে বলেছিলেন, ‘জালিয়াতদের ধরতে বাধা নিজের দলের লোক।’ একই বছরের ৮ জুলাই সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ‘যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন, বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। কেননা, ব্যাংকটিতে হরিলুট হয়েছে। আর এর পেছনে ছিলেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই। তাঁর ব্যাংকবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের কারণেই বেসিক ব্যাংক সমস্যায় জর্জরিত হয়েছে। তাঁর ব্যাংকবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোনো সমস্যা হবে না।’ এর পরের বছর জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবারও বলেন, ‘ঋণ জালিয়াতিতে শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল।’ এমনকি দুদক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানেও তিনি বলেছিলেন, ‘দুদকের কাছে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে তিনি অভিযুক্ত (হি হ্যাজ বিন ব্লেমড) হয়েছেন। এখন দেখা যাক দুদক কী ব্যবস্থা নেয়।’
সাবেক অর্থমন্ত্রী এরপরও শেখ আবদুল হাইকে নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। সংসদেও অনেকবার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু দুদক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তারা শেখ আবদুল হাইয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতাই পায়নি। নানা সমালোচনার মুখে ২০১৭ সালে শেখ আবদুল হাইকে দুদক ৬ বার ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তারপর থেকে আবার চুপ। সর্বশেষে শেখ ফজলে নূর তাপস আবদুল হাইকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এই প্রশ্ন তো সবার। দুদকের কাছ থেকে উত্তর পাওয়াটা এখন জরুরি। কারণ, সাধারণ মানুষের অর্থ নিয়ে যাঁরা নয়ছয় করেন, তাঁদের অপরাধ অনেক বেশি। যাঁরা জুয়া খেলতে যান, তাঁরা নিজের সিদ্ধান্তেই সেখানে যান। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে যখন ব্যাংকে টাকা রাখেন, কারসাজি হবে না এই আশ্বাসে শেয়ারবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করেন, তাঁদের অর্থ নানা কারসাজি করে যাঁরা আত্মসাৎ করেন, তাঁদের শাস্তি হওয়াটা বেশি জরুরি। কেবল অবৈধ ক্যাসিনোই নয়, মতিঝিলের সব অবৈধ কর্মকাণ্ডেরই অবসান হোক। বিশেষ করে ব্যাংককে বলা হয় অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। অর্থনীতিবিদেরা বলেন, এই হৃৎপিণ্ডে রক্ত ঝরছে। শেয়ারবাজারের ক্ষত অনেক পুরোনো। দেশজুড়ে নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। ব্যাংক ও শেয়ারবাজারও এর আওতায় আসুক। আর তা শুরু হোক শেখ আবদুল হাইকে দিয়েই।